top of page

কিংবদন্তির মহানায়ক মাওলানা শামসুল হক পাঁচবাগী (রঃ)।। আনোয়ারুল কাইয়ূম কাজল

মাওলানা শামছুল হুদা পাঁচবাগী (১৮৯৭- ২৪ শে সেপ্টেম্বর ১৯৮৮) ছিলেন উপমহাদেশে মুসলিম জাতিসত্ত্বার প্রবক্তা। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাসংস্কারক, সমাজহিতৈষী,চির সংগ্রামী-বিপ্লবী, আধ্যাত্মিক রাহ্বার ও মোজাদ্দিদ।


উপমহাদেশের রাজনীতির প্রবাদ পুরুষ, বাংলার প্রথম স্বাধীনতাকামী রাজবন্দী (জাতীয় সংসদে স্বীকৃত) ইংরেজ শাসনাধীন ভারতে মুসলমানদের ক্ষয়িষ্ণু অবস্থান দৃষ্টিভঙ্গির পশ্চাৎপদতা সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ে তিনি নতুন জীবনদৃষ্টি ও বিশ্ববীক্ষা নির্মাণে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন।


তিনি একাধারে-প্রসিদ্ধ আলেমেদ্বীন, দূরদৃষ্টি সম্পন্ন তীক্ষ্ণমেধাবী লেখক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক,সমাজসেবক ও রাজনীতিবিদ।

তিনি ছিলেন মানবতাবাদী চেতনায় উজ্জীবিত সর্বজন শ্রদ্ধেয় অলিয়েকামেল।

বাঙালি মুসলিম পূণর্জাগরণের সব্যসাচী কারিগর। ঘনঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত জাতির দূর্দিনের মুক্তির কান্ডারী,

আলোর দিশারী ও তাঁর কালের আলোকিত মানুষ।


অবিভক্ত ভারতের অবহেলিত এ অঞ্চলের জনমানুষের চেতনার বাতিঘর। এ মহান জ্ঞানতাপস আপন উদ্যোগ কর্মপ্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে মুসলমান জীবন ও মানসে যে শ্রেয় চেতনা নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন তাতে পরিপূর্ণ সাফল্য অর্জন করেন। জীবনের প্রায় পুরোটা সময় অনগ্রসর মুসলমান জাতির উন্নতির লক্ষ্যে অান্দোলন-সংগ্রাম,জেল-জুলুম,হুলিয়া বরণ করে মানুষের মুক্তির জন্য ব্যয় করেছেন।


জন্ম ও প্রাথমিক জীবন

মাওলানা শামছুল হুদা পাচঁবাগী ইংরেজী ১৮৯৭ খৃষ্টাব্দে ও বাংলা ১৩০৩ সালের ফাল্গুন মাসে ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও উপজেলার মাইজবাড়ী নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কিছুদিন পরে তাঁর পিতা গফরগাঁও এর পাঁচবাগ নামক গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। পরবর্তীতে সেই পাঁচবাগ গ্রামটি এই ক্ষণজন্মা মহাপুরুষের বাসস্থান হওয়ার জন্য বিখ্যাত হয়ে যায় । তিনিও এই গ্রামেই লালিত পালিত হয়ে বিশ্বের দরবারে 'মাওলানা পাচঁবাগী' নামেই খ্যাতিলাভ করেছেন। জন্মসুত্রে তিনি এমন পিতার সন্তান ছিলেন যিনি শিক্ষা, সাধনায়, জ্ঞানে ও অধ্যাত্মিকতায় যথেষ্ট উৎকর্ষ সাধন করে ছিলেন। তার নাম মৌলভী ক্বারী রিয়াজ উদ্দিন। তিনি কিংবদন্তি আলেম রশিদ আহম্মদ গাঙ্গোহীর খলিফা ছিলেন। অন্যাদিকে তাঁর মাতা উম্মে কুলসুমও ছিলেন অত্যন্ত পরহেজগার নারী। এমনই পিতা মাতার ঘরে তাঁর জন্ম।


শিক্ষা জীবন

শিশুকালে তিনি মাতার নিকট শিশু শিক্ষা শুরু করেন। কোন স্কুল বা মাদরাসায় ভর্তি না হয়ে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন। তিনি এতই মেধাশক্তির অধিকারী ছিলেন যে কোন বিষয়ই একবারের অধিক পড়ার প্রয়োজন হতনা। তবে এই অসাধারণ স্মৃতিশক্তি ও তীক্ষ্ম মেধাকে আল্লাহ পাকের খাস্ দান বলে তিনি নিজেই বর্ননা করতেন।


মাদরাসায় ভর্তির পর হতেই শামছুল হুদার প্রতিভার বিকাশ ঘটতে থাকে। তিনি খুব আগ্রহের সাথে প্রতিটি শ্রেনীতে সিলেবাস বর্হিভুত নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে থাকেন। প্রথম বিভাগে প্রথম হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করে ছিলেন। তিনি জামাত-ই-উলার চুড়ান্ত পরিক্ষায় অংশ গ্রহন করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ৯৮% নম্বর প্রাপ্ত হয়ে মাত্র ১২ বছর বয়সে প্রথম শ্রেনীতে প্রথম স্থান অধিকার করত: স্বর্নপদক লাভ করেন। অতপর উচ্চ শিক্ষার ব্যাপারে তিনি শিক্ষকদের সাথে পরামর্শ ক্রমে দ্বীনি ইলমেরপাশাপাশি বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষা লাভের জন্য ভারতের রামপুর স্টেট মাদরাসায় ভর্তি হয়ে লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে সেখানে গমন করেন। সেখানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বর্নপদকপ্রাপ্ত ছাত্রকে দেখার জন্য শিক্ষিত মহলে সাড়া পড়ে যায়। এবং ঐ মহল তাঁকে ডেকে নিয়ে সাক্ষাৎ করে সম্মাননা জানান।


মাদরাসায় ভর্তি হওয়ার পুর্বেই হাদিসের ক্লাসে স্বেচ্ছায় যোগদান করে ছিলেন। মুহাদ্দিস সাহেব একটি হাদিস পড়ানোর পর মাওলানা শামছুল হুদা অত্যন্ত বিনয়ের সাথে মুহাদ্দিস সাহেবকে বললেন যে এই প্রসংগে হযরত আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত আরেকটি হাদিস রয়েছে যা উল্লেখ করলে বিষয়টি অধিকতর বোধগম্য ও পরিস্কার হতে পারে। অতপর তিনি সেই হাদিস খানা মুহাদ্দিস সাহেবের অনুমতিক্রমে বিশুদ্ধভাবে বর্ননা করলেন। মুহাদ্দিস মহোদয় বিস্মিত হয়ে বললেন যে ছাত্র হাদিসের এমন উচ্চ পর্যায়ের কিতাব পড়াশোনা করেছে তার আর এখানে ভর্তি হয়ে সময় নষ্ট করার প্রয়োজন নেই। বরং নিজের দেশে গিয়ে জনগনের সেবা করাই উত্তম।


তখন রামপুরের অধ্যক্ষ ছিলেন মাওলানা আব্দুল আজিজ সাহারানপুরী। তিনি ছিলেন দর্শনশাস্ত্রের উঁচু স্তরের পন্ডিত। মাওলানা শামসুল হুদা তার কাছ থেকে দর্শনের পাঠ গ্রহণ না করে দেশে ফিরতে চাচ্ছিলেন না। তবে মাওলানা সাহারানপুরীও ছিলেন কিঞ্চিৎ কঠোর স্বভাবের। ফলে তিনি মনে মনে কিছুটা ভীতও ছিলেন। এরপরেও সাহস সঞ্চার করে মাওলানা সাহারানপুরীর কাছে দর্শনপাঠের আবেদন জানান৷ সেখানেও তিনি সফল হন। একের পর এক দর্শনশাস্ত্রের বড় বড় সব কিতাব আত্মস্থ করে ফেলেন। মাওলানা সাহারানপুরী তার উপর আশ্বস্ত হলেন৷ এবং বললেন, তোমার পড়ালেখা সম্পন্ন বলেই আমি আশা করি। তুমি এখন দেশে ফিরে জনসেবায় নিয়োজিত হওয়াই বেশী মঙ্গলজনক হক।

মাওলানা শামসুল হকের জ্ঞান অন্বেষণের নেশা তখনো কাটেনি। তিনি ইংরেজি শিক্ষার, জন্য লাহোরের অরিয়েন্টাল কলেজে চলে যান। অরিয়েন্টাল কলেজ থেকে মাওলানা শামসুল হুদার তেমন কিছু শেখার ছিল না। তিনি তখনো ভাল মানের ইংরেজি জানতেন।


চির বিপ্লবীর রাজনৈতিক কর্মকান্ড

-----------------------------------------------------

১৯৩৬ সালে যখন গফরগাঁও উপজেলার ঐতিহ্যবাহী উস্থি ইডনিয়ন ভেঙ্গে পাঁচবাগ ইউনিয়নের সৃষ্টি হয়, তখন অান্দোলন- সংগ্রামের অগ্রমহানায়ক কিংবদন্তি মাওলানা শামছুল হুদার সম্মানে ইউনিয়নের নামকরণ হয় পাঁচবাগ ইউনিয়ন। এবং শামছুল হুদা পাঁচবাগী (রহঃ) হন নতুন সৃষ্ট ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা নির্বাচিত চেয়ারম্যান।


১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত এমএলএ ও এমএনএ (অাইন প্রণেতা) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি ১৯৩৭ সালে কৃষক প্রজা পার্টির প্রার্থী হিসেবে বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৪০ সালে আসাম ও বঙ্গ প্রদেশ নিয়ে একটি পৃথক রাজ্য গঠনের লক্ষ্যে ‘ইমারত পার্টি’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন এবং তিনি সভাপতি নিযুক্ত হন ও সানাউল্লাহ ছিলেন দলটির সহসভাপতি। ১৯৪৬ সালে ২য় বিশ্ব যুদ্ধের পর তৎকালীন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে তাঁর ইমারত পার্টি প্রাদেশিক নির্বাচনে জয়ী হয়। কথিত আছে নির্বাচনের সময় মাওলানা সাহেব সাত মাইল দীর্ঘ এক মিছিল সমেত গফরগাঁয়ে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের সমাবেশ পন্ড করে দিয়ে ছিলেন! ১৯৫৪ সালে যুক্ত ফ্রন্টের হয়েও নির্বাচন করে প্রতিপক্ষকে হারিয়েছেন।


চির সংগ্রামী রাজনীতিবিদের

কর্মময় জীবন

-------------------------------------

মজলুম জনমানুষের মুক্তি আন্দোলনের বংশীবাদক, আলোড়ন সৃষ্টিকারী বিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান, মাওলানা শামছুল হুদা দেশে ফিরে আসার পর সামাজিক অবস্থা ও জনগণর করুণদশা দেখে ব্যাথিত হয়ে পড়েন। বিশেষ করে হিন্দু জমিদারদের অত্যাচারে দেশের জনগণ সর্বশান্ত হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করত৷ এবং মুসলমান প্রজারা গরু কোরবানী করতে পারতনা। যদি কোন মুসলমান গরু কোরবানী করত তা হলে জমিদারদের লাঠিয়াল বাহিনী জরিমানা আদায় করত। মাওলানা শামছুল হুদা এর প্রতিবাদে আন্দোলনের ডাক দেন এবং হোসেনপুর এলাকায় ঈদের জামাতে নামাজ আদায় করে প্রকাশ্যে গরু কোরবানী করেন। এরপর হতেই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, জমিদারদের বিরুদ্ধে আন্দোলন, পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনসহ দেশের মেহনতি কৃষকদের মুক্তির জন্য সারা জীবন আন্দোলন সংগ্রাম করে গেছেন। আন্দোলন করার কারণে ব্রিটিশ সরকার, জমিদার সংগঠন এবং পাকিস্তান সরকার সব মিলিয়ে ১০২১টি মামলা দায়ের করে তাঁর বিরুদ্ধে। এসব মামলার কারনে তাকে ময়মনসিংহ শহরে ৮ বছর নজরবন্দী হিসাবে আটকে রাখে।

তিনি সকল মামলা সাহসিকতার সাথে মোকাবেলা করেন।

বরাবরই মামলা-মোকাদ্দমায় মাওলানার পক্ষে অাইনি লড়াই করেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা একে ফজলুল হক। তিনি ছিলেন শেরেবাংলা ও মাওলানা ভাসানীর শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব।


কারা বরণ

-----------------

মাওলানা শামসুল হুদা অাজীবন অবহেলিত নিপীড়িত নিষ্পেষিত নিগৃহীত জনগোষ্ঠীর অধিকার অাদায়ের সংগ্রামে নেতৃত্বে দিয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহী থেকে শুরু করে নানা ধরনের মামলা হয়েছে । এ জন্য তাঁকে ভীষণ দুঃখ-কষ্ট,জেল-জুলুম,হুলিয়া সহ্য করতে হয়েছে। তিনি তাঁর সংগ্রামী জীবনে মোট ৪৭ বার কারাবন্দী হয়েছিলেন,।


* প্রেস স্থাপন ও ইশতেহার, লিফলেট প্রকাশ

----------------------------------------------------

বাঙালি মুসলিম মহাজগরণের পুরোধা ব্যক্তিত্ব মাওলানা শামছুল হুদা জাতি,ধর্ম,বর্ণ নির্বিশেষে সকল জনগনের মুক্তির জন্য আজীবন সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। তিনি অত্যাচারী হিন্দু জমিদার,বৃটিশ ও পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম বেগবান করার জন্য, তাঁর অাহবান মুক্তিকামী মানুষের কাছে পৌঁছাতে অজপাড়াগাঁ পাচঁবাগ গ্রামে 'শামছি'প্রেস নামে একটি প্রেস স্থাপন করেন। ময়মনসিংহ শহরে 'ফারুকী' প্রেস নামে অারো একটি প্রেস স্থাপন করেন। উক্ত প্রেস হতে প্রচারপত্র-লিফলেট,হ্যান্ডবিল ও ইস্তেহারের মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন পরিচালনা করতেন।

তিনি আরবি, উর্দু ও ফার্সি ভাষায় ১০,০০০ এর বেশি প্রচারপত্র ছাপিয়েছিলেন। তিনি প্রচারপত্রে পাকিস্তান সৃষ্টির প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন এছাড়াও তিনি অবিভক্ত স্বাধীন বাংলার সমর্থক ছিলেন


* শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন ও সংস্কার

-------------------------------------------------

মহান শিক্ষাসংস্কারক মাওলানা অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন। যে সময় মাদরাসায় শুধুমাত্র আরবি ছাড়া অণ্য কোন বিষয় সিলেবাসে অর্ন্তভুক্ত ছিলনা তখনকার সময়ে তিনি তার প্রতিষ্ঠানে বাংলা, ইংরেজি, বিজ্ঞান, গনিত সহ সিলেবাস বর্হিভুত বিষয় সমুহ পড়াশোনা করাতেন। তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে মাদরাসা শিক্ষা আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় উন্নীত হয়েছে। তার প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা শেষে সারা বাংলাদেশে অসংখ্য ছাত্র নিজ নিজ এলাকায় আধুনিক আলিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করে ইসলামী শিক্ষার প্রসার করে। যা বর্তমানে মাদরাসার রোডম্যাপ হিসাবে পরিচিত আধুনিক শিক্ষায় পরিনত হয়েছে। তিনি নারী শিক্ষার অগ্রপথিক ছিলেন। তিনি নিজ বাড়ীতে সিনিয়র ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসা, বালক উচ্চ বিদ্যালয়,বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, ইয়াতিমখানা ও ময়মনসিংহ শহরে একটি মহিলা কলেজ স্থাপনসহ বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে সমাজকে শিক্ষার অালোয় উদ্ভাসিত করেছেন। তদানিন্তন পাকিস্থানে সর্ব প্রথম তার দুই মেয়ে কামিল পাশ করেন। তিনি

শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন ও সংস্কারে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহন করে প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে থাকবেন অনন্তকাল।


* মহান ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহন

------------------------------------------------

বাংলাদেশের মাটি যে সকল স্মরণীয় ব্যক্তিত্বকে ধারণ করেছে তার মধ্যে মাওলানা শামছুল হুদা অন্যতম একথা নির্ধিদ্বায় বলা যায়। বাংলার ইতিহাসের পাতায় যে ক’জন মানুষের নাম স্বর্ণালী অক্ষরে লিখা আছে তার মধ্যে মাওলানা শামছুল হুদা অন্যতম। ইতিহাসের উজ্জ্বল নক্ষত্র মাওলানা শামছুল হুদা ১৯৫২ সালে মহান ভাষা আন্দোলনে স্বক্রিয় অংশ গ্রহন করেন। তিনি ভাষা আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন, রাষ্ট্র ভাষা বাংলা হউক এটা তিনি মনে প্রাণে চাইতেন।


* মহান মুক্তি যুদ্ধে অবদান

----------------------------------------

মুক্তিযুদ্ধে তিনি সরাসরি স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষ গ্রহণ করেন । কেননা ভারত বর্ষ স্বাধীন হওয়ার সময় থেকেই মাওলানা শামছুর হুদা পাকিস্তানের বিরোধীতা করেন। এবং বঙ্গভঙ্গ রদের পক্ষে অবস্থান নেন। ১৯৭১ সালে তিনি রাজাকার, আলবদর ও পাকিস্তানী হায়েনাদের হাত থেকে হিন্দু, মুসলমান পুরুষ ও মা বোনদের রক্ষা করতে তার বাড়ীতে মসজিদে ও মাদরাসায় আশ্রয় দান করেন। তাদের ইজ্জত ও জীবন রক্ষা করে সকলের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকেন। মুক্তিযুদ্ধে তার বাড়িতে শরণার্থীদের তিনি খাবারের ব্যবস্থা করতেন এবং মুক্তিযুদ্ধে আগ্রহী যুবকদেরকে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহনের জন্য নির্দেশ দিতেন এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।

শামছুল হুদা পাঁচবাগী ষাটের দশকে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন।


* পথিকৃৎ সম্পাদক ও প্রকাশক

-----------------------------------------

ধীমান জ্ঞানতাপস,প্রখ্যাত সাংবাদিক, সাহিত্যিক,বহুভাষাবিদ,অালেমেদ্বীন

মাওলানা শামসুল হুদা পাঁচবাগী উপমহাদেশের একজন পথিকৃৎ সাংবাদিকও বটে। তিনি বাংলা, আরবী ও উর্দু ভাষায় যথাক্রমে ‘দ্বীন-দুনিয়া, হুজ্জাতুল ইসলাম ও তর্জুমানে দ্বীন’ নামে তিনটি পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন। ‘দ্বীন-দুনিয়া’র প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৩৩৬ সালের আষাঢ় মাসে, তাঁর গ্রামের বাড়ি গফরগাঁও থানার পাঁচবাগ থেকে।


* মাওলানা শামসুল হুদা পাঁচবাগীর কথিপয় বিখ্যাত উক্তি

-----------------------------------


বহুমাত্রিক উজ্জ্বল প্রতিভার অধিকারী অগ্নিপুরুষ মাওলানা পাঁচবাগী (রহঃ) ছিলেন-দূরদৃষ্টি সম্পন্ন দ্বায়ী ইলাঅাল্লাহ।

অাল্লাহর মনোনীত জীবন ব্যব্স্থা ইসলামী বিধি-বিধান প্রচার-প্রসারের নিবেদিত প্রাণ মহান মুজাহিদ ও সংস্কারক।

মাওলানা সামছুল হুদা কুফুরি শেরেকি, বেদাতি,কুসংস্কার,সুদ-ঘোষ,অন্যায়,অবিচার,জুলুম,কবর পূজা,মাজারপূজা,কবরে অালোকসজ্জা,বাতি প্রজ্জ্বলন,উরস করা ইত্যাদির বিরুদ্ধে আজীবন জেহাদ করে গেছেন। তিনি বলতেন-

'কবর পূজা অার দূর্গা পূজা একই কথা'


তিনি তাঁর ইশতেহার, প্রচারপত্রে পাকিস্তান সৃষ্টির প্রস্তাবের বা পাকিস্তান তৈরী অান্দোলনের বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি বলতেন-

‘মিছে পাকিস্তান জিন্দাবাদ, ইংরেজকে তাড়াই পাঞ্জাবি আনতে যাই, বাংলা নহে স্বাধীন, বাংলা চির পরাধীন’, ‘পাকিস্তান নয় ফাঁকিস্তান, পাকিস্তান হবে জালিমের স্থান।’


এছাড়া ও তিনি বলেছিলেন -

'কিশোরগঞ্জের কিশোর দল, তারচেয়ে ভালো ভেড়ার দল'।


আধ্যাত্মিক জগতের এ মহান পথ প্রদর্শক তাঁর আধ্যাত্মিক ক্ষমতার কথা আজো মানুষের মুখে মুখে ফেরে। দৃশ্যমান লৌকিক ক্ষমতা বা কারামাত প্রদর্শনেও তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্থ।


* অনুকরণীয় আদর্শ ও সমাজসেবা

----------------------------------------------------


সত্যের ঝান্ডাবাহী অগ্রণীমহান সেনানায়ক,আমৃত্যু তিনি ঐতিহাসিক শাহজাদী বেগম ওয়াকফ স্টেটের মুতাওয়াল্লী ছিলেন। শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের সাথে মওলানা পাঁচবাগীর আপোষহীন সংগ্রামে অনুপ্রাণিত হয়ে টিপু সুলতানের বংশধর মোগল কন্যা শাহজাদী বেগম মাওলানা শামছুল হুদা পাঁচবাগীর অজান্তেই তাকে বৃহত্তর ঢাকা ও ময়মনসিংহের তিনটি তৌজিভুক্ত বিশাল ওয়াকফ সম্পত্তির মুতাওয়াল্লী মনোনীত করে যান। শামছুল হুদা পাঁচবাগী শাহজাদী বেগম ওয়াকফ স্টেটের মোতাওয়াল্লি ছিলেন।

তিনি মুসমানদের হীনমন্যতা দুর করতে পার্শ্ববর্তী হেসেনপুর বাজারে নিজ হাতে মাছ বিক্রি করে দেখিয়ে গেছেন কোন কাজই ছোট নয়।


মৃত্যুবরণ

------------

শতাব্দী অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামী চিন্তাবিদ নকীব মাওলানা শামছুল হুদা পাঁচবাগী (রহঃ) আজীবন মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য আপোসহীন সংগ্রাম করে গেছেন। তিনি সাধারণ মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য জমিদার ও সরকারের বিরুদ্ধে অান্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্বে দিয়ে কিংবদন্তির মহানায়কে পরিণত হয়েছেন।


মহান আল্লাহর অলি, প্রিয়বান্দা, দ্বীন ইসলামের সাধক, সাবেক জাতীয় গণপরিষদ সদস্য ১৯৮৮ সালের ২৪শে সেপ্টেম্বর ৯১ বছর বয়সে

ময়মনসিংহে নিজ বাসভবনে

মহান রবের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যান, মৃত্যু যবানিকার ওপারে। মৃত্যুর পর পাঁচবাগ জামে মসজিদের উত্তর পাশে তাকে সমাহিত করা হয়। -------------------------

Comments


পাঠক নিবন্ধন ফর্ম​

জমা দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ!

লেখা প্রদানের জন্য মেইল করুন

banglakotha2011@gmail.com

©2025 by Banglakotha

Bangladesh

bottom of page