top of page

কালীকচ্ছ আমার কালীকচ্ছ ।। ড. সুনীল কুমার তলাপাত্র

“মা বুঝি গান গাইত আমার দোলনা ঠেলে ঠেলে- মা গিয়েছে, যেতে যেতে গানটি গেছে ফেলে।”

আমার জন্ম ১৯৩১/৩২ খ্রিস্টাব্দের কোনোএক সময়ে সুমহান ঐতিহ্যমণ্ডিত গ্রাম কালীকচ্ছের মনিরবাগে। আমার ছেলেবেলার সহচরী মা কালীকচ্ছ গ্রাম হারিয়ে গেছে সীমানা রেখার ওপারে আর কিছুটা সময়ের প্রলেপে। কিন্তু সেই দিনগুলি, যার বিষয়বস্তু ছিল গ্রামের বর্ষাভেজা মাঠে খেলাধুলা, রাস্তাঘাট লুকিয়ে রাখা কানায় কানায় ভরা খালে-বিলে নৌকা বাওয়া, হুইলের ছিপের বড়শি একটানে পুকুরের ওপারে নিয়ে যাওয়া বড় রুই মাছ, মাঝ রাত্তিরে চুরি করা পাঠার মাংসের চড়ুইভাতি -যার স্বাদই আলাদা, ক্রিকেটের পূর্বপুরুষ কালীকচ্ছের বৈশিষ্ট্য গুটিদারা খেলা, আঁকাবাঁকা অনেকটা পথ বর্ষাকালে জল বেয়ে খালি পায়ে হেটে মাইনর স্কুল, সরাইল অন্নদা হাইস্কুল এবং নবম ও দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় কালীকচ্ছ পাঠশালায় যাওয়া-আসা, লন্ঠনের আলোতে পড়তে পড়তে ঢুলুনিতে ঝিঁমিয়ে পড়া এবং ছোটকাকার (কালীকচ্ছ পাঠশালার উপপ্রধান শিক্ষক প্রয়াত হরমণি তলাপাত্র ওরফে মন্দন মাস্টার) আচমকা বেত পিঠে পড়তেই হঠাৎ করে জেগে উঠে আবার পড়া শুরু করা, ভেজানো পাট গাছ (নাইল্যা) থেকে পাট বার করা, বছরের নানা সময়ে আমাদের বাগানগুলি থেকে নানা ফুল, তরি-তরকারি, যেমন-বেগুন, ভেন্ডি, শিম, কুমড়ো, লাউ, চালকুমড়ো, নানা রকমের লেবু, কাঁচা লংকা, আর নানান ফল যেমন- পেয়ারা, কুল, আম, কাঁঠাল, জাম, বেদানা, বেল, চালতে সংগ্রহ করা, এমনকি নারকেল গাছেও ওঠা, ডাটা ক্ষেতে পুকুরের জল দেওয়া, সরষের ক্ষেত থেকে সরষে গাছ তোলা, উঠানে গরু দিয়ে কাটা ধানে মলন দেয়া, লাকড়ি ইত্যাদি উঠানে রোদে দেয়া আর তোলা, এমনকি কয়েকবার লাঙ্গল দিয়ে সখের চাষ করা- কিশোর জীবনের এ সবই আমার হারিয়ে যাওয়া মায়ের গান হয়ে আমার বুকের গভীরে সারা জীবনের সঙ্গী হয়ে রয়েছে।


কালীকচ্ছ আমার জন্মভূমি, আমার বাল্যস্মৃতি জড়িত কালীকচ্ছ গ্রাম ত্রিপুরা জেলার বর্তমানে বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল থানার অন্তর্গত। লম্বায় উত্তর-দক্ষিণে আড়াই মাইল, আয়তন প্রায় ৮ বর্গমাইল, লোককসংখ্যা ছিল ১১/১২ হাজার। অনেকগুলি পাড়া ছিল। সবচেয়ে বড় নন্দীপাড়া, দত্তপাড়া, ধামাইত পাড়া, মনিরবাগ (রায় পাড়া ও তলাপাত্র পাড়া মিলে), বারুইজীবি পাড়া প্রভৃতি। এই পাড়াগুলোই এক-একটি গ্রামের মতো ছিল। তাছাড়া ছিল মালিপাড়া, কুমারপাড়া, কর্মকার পাড়া, নাপিতপাড়া ও কৈবর্তপাড়া। যে পাড়ায় যে জীবিকার বা পদবীর লোকের বহু বছর ধরে বাস সে অনুযায়ীই পাড়ার নামকরণ হয়েছিল।

দেশ ছেড়েছি সেই ১৯৪৭ সালেই। সর্বশেষ কালীকচ্ছ গিয়েছি সেও অ-নে-ক আগে। তারপরও সবকিছু মনের মনিকোঠায় জমে আছে। মনে পড়ছে গ্রামের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে আমাদের ৩-৪ মহলা বাড়ি। বাগানগুলোর মাঝের রাস্তা দিয়ে বাইরে এলেই বেশ বড় মাঠ, তার পূর্ব দক্ষিণে সতী অন্নপূর্ণা দেবীর (আমার ঠাকুরদার ঠাকুরমা/রামমোহন তলাপাত্রের স্ত্রী সাধ্বি অন্পূর্ণা দেবীর সমাধিস্থলে মাতৃসাধক বসন্তকুমার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত) কালীমন্দির। মাঠের পূর্বে ও দক্ষিণ প্রান্তে নানারকম ফল গাছ। দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে টিউবওয়েলের পাশেই একটি বিরাট চালতে গাছ- যার তলায় বসে আমরা গ্রীষ্মের ছুটিতে স্কুলের হোমটাস্ক, অঙ্ক ইত্যাদি করতাম। আমরা ৫/৬ জন ভাই-ভাইপো মিলে কালীবাড়ির ঢাকা বারান্দায় পঞ্চম -দশম শ্রেণী পর্যন্ত পরীক্ষার দিনগুলো বাদে প্রতিদিন সন্ধ্যায় বসন্ত কুমার রচিত ৪/৫ টি গান তাঁরই সুরে ঢোল-করতাল বাজিয়ে গাইতাম - যেমন ‘এসো নেচে নেচে যাই মায়ের কাছে, বেজার কেন মিছে থাক তুমি মন....’, ‘মায়ের কাছে যেতে যাব কোন পথে কে পার বলিতে, বলা না রে ভাই’, ‘আয় সবে মিলে হৃদয় খুলে হরি হরি বলে নাচি রে, ‘কালী নামের লুট পড়েছে, কে ধরবি রে দৌড়ে আয়’ ইত্যাদি। শেষ গানটির পর কিছু বাতাসা লুট হত- পাড়ার অনেকেই তখন আসতো লুটের প্রসাদ নেওয়ার জন্য। প্রতিবছর শীতকালে আমাদের কালীবাড়ির মাঠে অনুষ্ঠিত সতীদাহের মেলাতে বহু জিনিষ প্রদর্শিত ও বিক্রি হতো এবং প্রচুর লোকসমাগম হতো। বিভিন্ন সময়ে প্রতি বছর গ্রামে শ্মশানকালীর মেলা, রক্ষাকালীর মেলা, চরক মেলা অনুষ্ঠিত হতো।

এবার আমার স্কুল জীবনের কথা কিছু বলি। বার্মার মেমিও শহরে একটি ইংরেজী মিডিয়াম স্কুল থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে প্রথম হয়ে পাস করে যুদ্ধের আগে দেশে চলে আসি ১৯৪১ সালের গ্রীষ্মের ছুটির সময়। ছুটির পর জুন মাসে কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার পর গ্রামের ছেলেদের মাইনর স্কুরে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হতে পারি। দু’বছর পর আড়াই মাইল দূরে সরাইল অন্নদা হাইস্কুলে ভর্তি হই। আরো দু’ বছর পর ১৯৪৫ সালে আমাদের গ্রামে আগের বছর প্রতিষ্ঠিত হাইস্কুল ‘কালীকচ্ছ পাঠশালায়’ নবম শ্রেণীতে ভর্তি হই। এই স্কুলটি কুমিল্লার ‘ঈশ্বর পাঠশালা’র মডেলে তৈরি করে শুরু করেন ‘ঈশ্বর পাঠশালা’র অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক শ্রী জানকী নাথ সরকার। স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন আমাদের গ্রামের বিখ্যাত সংস্কারক স্বনামধন্য শ্রী প্রবোধ চক্রবর্তী। প্রতিদিন পড়াশুনা আরম্ভ হওয়ার আগে সব ছাত্র মিলে কয়েকটি স্বদেশি ও ভক্তিমূলক গান গাওয়া হতো। যেমন ‘ধনধান্যে পুষ্পে ভরা. . . ..দুর্গম গিরি কান্তার মরু........ মধুকর রঞ্জিত মালতী মন্ডিত.... .. প্রলয়পয়োধিজলে ধৃতবানসি বেদম......... ভবসাগর তারণ কারণ হে.......এবং শেষে জনগণমন অধিনায়ক জয়ঃ হে.......। আমি স্কুল জীবনে সব শ্রেণীতে সব পেপারে প্রথম হতাম। আমার প্রতিযোগী কেউ ছিল না বলে পড়াশুনার বাইরে নানাদিকে ঝোঁক ছিল- তা প্রথমেই বলেছি। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার বছর ম্যাট্রিক পাশ করি। আমাদের ১৫-২০ জন সহপাঠী সবাই পাস করে এবং আমার পরীক্ষার ফল ভাল হওয়ায় স্কুলে ১ দিন ছুটি হয়েছিল। ১৯৫৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে ডক্টরেট ডিগ্রি পাওয়ার পর আমার সম্বর্ধনা উপলক্ষে স্কুল ১২ টায় ছুটি হয়েছিল এবং স্কুলে হিন্দু- মুসলমানদের বিরাট সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অনেক হিন্দু ও মুসলমান শিল্পীরা আবৃত্তি নাচ, গান, যন্ত্রসংগীত ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বেলা ২ টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত অনুষ্ঠান চলেছিল- তাতে আলি আকবরের ১৩/১৪ বছরের ভাগনে অপূর্ব সেতার বাজিয়েছিল। পরে ১৯৫৯ সালে আমার ত্রিপুরা জেলার প্রথম প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ বৃত্তি পাওয়া উপলক্ষে আমাদের স্কুল আরও একবার ছুটি হয়েছিল। সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করি আমাদের মাইনর স্কুলের শিক্ষক সর্বশ্রী দয়াল সেন, নরেন দেব ও হরেন দেব, আমাদের অতিপ্রিয় কালীকচ্ছ পাঠশালার প্রধান শিক্ষক শ্রী জানকীনাথ সরকার এবং অন্যান্য আদর্শ শিক্ষকবৃন্দ সর্বশ্রী নিকুঞ্জ বিহারী দত্ত, দীনেশ সেন, দ্বিজেন ভট্টাচার্য, ঋষীকেশ ভট্টাচার্য, শৈলেন সেন, মনোজ নন্দী, বিষ্ণুপদ নন্দী, রাসবিহারী ভট্টাচার্য, সুকুমার দত্ত, নগেশ সেন (সরাইল অন্নদা হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক) যাঁদের প্রত্যেকের কাছে স্কুলজীবনে অনেক উৎসাহ ও উপদেশ পেয়েছি- এঁরা অধিকাংশই কালীকচ্ছের বাসিন্দা ছিলেন।

আমার শৈশব কৈশোরের ঘটনাবহুল দিনগুলো আমার জীবনে শ্রেষ্ঠ পুঁজি। তার পর কত কাক-ডাকা ভোর গেছে-কত বছর চলে গেছে- কত ঘটনা ঘটে গেছে- দেশ ভাগ হয়ে গেছে! আমাদের দেশ প্রথমে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ ও পরে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ হয়ে গেছে! কালীকচ্ছে আমাদের বাড়ীর সর্বশেষ বাসিন্দা আমাার ছোট কাকা, (শ্রী হরমণি তলাপাত্র- কালীকচ্ছ পাঠশালার অবসরপ্রাপ্ত উপ-প্রধান শিক্ষক) কাকিমা সহ ১৯৭১ সারে মুক্তিযুদ্ধের অরাজকতার সময় এক রাত্রিতে হঠাৎ অচেনা দুর্বৃত্তদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পালিয়ে পরদিন ভোরে বাড়ীঘর, বিষয়-সম্পত্তি সব ফেলে রেখে নৌকা করে আগরতলায় চলে আসতে বাধ্য হন এবং পরে কলকাতায় আসেন। কালীকচ্ছে আমাদের বাড়িঘর, জমিজামা সব বেদখল হয়ে যায়। এসব সত্ত্বেও আমার গ্রামটি একান্ত আমার হয়েই অখন্ডভাবে আমার মনের গভীরে আজও বিরাজমান। এ সবকিছুই এত স্পষ্ট রয়েছে যে, কবির কথায় বলি- "সে আজিকে হল কত কাল তবু মনে হয় সেদিন সকাল”

লেখক: ইউজিসি অধ্যাপক ও প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান, কেমিস্ট্রি বিভাগ, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসিডেন্ট, ইউন্ডিয়ান কেমিক্যাল সোসাইটি (২০০২-২০০৩) নোবেল পুরস্কার মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য ( কেমিস্ট্রি, ১৯৮৯ ও ১৯৯৪) ভাইস প্রেসিডেন্ট, কালীকচ্ছ সম্মিলনী, কলিকাতা ২০১ মানিকতলা মেইন রোড, কলকাতা ফোন: ০০৯১-৯০০৭৩৮৪০১২ ০০৯১-৩৩-২৩৫৫৮৩৬২ (কালীকচ্ছ সম্মিলনী'র প্রথম প্রকাশনা, ১ মার্চ ২০০৯ কলকাতা থেকে সংকলিত ও ঈষৎ সংক্ষেপিত)

Comments


পাঠক নিবন্ধন ফর্ম​

জমা দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ!

লেখা প্রদানের জন্য মেইল করুন

banglakotha2011@gmail.com

©2025 by Banglakotha

Bangladesh

bottom of page