নজরুল এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া (পর্ব ১) ।। মোঃ জেহাদ উদ্দিন
- মো জেহাদ উদ্দিন
- Oct 1, 2021
- 0 min read
বাংলাদেশের যতগুলো জাতীয় পরিচিতি আছে তার মধ্যে কাজী নজরুল ইসলাম অন্যতম। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবি। জাতীয় পরিচিতিসমূহ যে কোন জাতির জন্য গর্ব ও অহংকারের জায়গা। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামও আমাদের নিকট তা-ই। জাতীয় কবির সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও স্থানসমূহও বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। বাংলাদেশে নজরুল স্মৃতিবিজড়িত যেসব স্থান সকলের নিকট বিশেষভাবে পরিচিত সেগুলো হল-ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল, কুমিল্লা শহর, কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার দৌলতপুর,র ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল, চুয়াডাঙ্গা, সিরাজগঞ্জ, মানিকগঞ্জ প্রভৃতি। এর বাইরেও বহু জায়গায় কাজী নজরুল ইসলাম ছুটে বেড়িয়েছেন স্বাধীনতার ঝাণ্ডা হাতে নিয়ে, সকল মানুষকে জাগ্রত করার মানসে। তবে নজরুল স্মৃতিচিহ্নসমূহ যে সকল জায়গায় যথাযথভাবে সংরক্ষিত হয়েছে সে কথা বলার কোন অবকাশ নেই। বরং চোখ বন্ধ করেই বলে দেয়া যায় যে, নজরুল স্মৃতিচিহ্নসমূহের প্রতি আমরা যথাযথ মনোনিবেশ করিনি। অযত্ন-অবহেলায় কালের আবর্তে অধিকাংশই বিলীন হয়ে গেছে। কাজী নজরুল ইসলাম কি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এসেছিলেন কি না এ বিষয়ে গবেষণা করা যেতে পারে। তবে তিনি যখন কুমিল্লায় আসেন, সেই সময়টিতে বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা ছিল কুমিল্লার আওতাধীন। নজরুলের কুমিল্লা আগমনের তেষট্টি বছর পর ব্রাহ্মণবাড়িয়া একটি আলাদা জেলা হিসেবে আবির্ভূত হয়। কবি ১৯২১ সালে সর্বপ্রথম কুমিল্লায় এসে কুমিল্লা শহরে রাত্রি যাপনের পর বন্ধু আলী আকবর খানের সাথে তাঁর গ্রামের বাড়ি মুরাদনগরের দৌলতপুরে এসে আড়াই মাসাধিককাল ছিলেন। তাঁর মতো সদা সক্রিয় প্রাণচঞ্চল একজন মানুষ দৌলতপুর গ্রামেই নিজেকে সীমিত রেখেছেন তা মনে করার কোন কারণ নেই। দৌলতপুর হল বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অত্যন্ত নিকটবর্তী একটি গ্রাম। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও মানুষের আতিথেয়তায় ভরপুর শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির সমৃদ্ধ জনপদ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কাজী নজরুল ইসলামের বিচরণ বিচিত্র কিছু নয়। পরবর্তীতে কাজী নজরুল ইসলাম রেলযোগে দুই বার সিলেট গিয়েছেন। প্রথমবার ১৯২৬ এবং দ্বিতীয়বার ১৯২৮ সালে। রেলে আসা-যাওয়ার পথে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেল স্টেশন স্পর্শ করেছেন। হয় তো তিনি ক্ষণকালের জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাটিতে নেমেছেনও; এখানকার জলপান করেছেন, মাটির গন্ধ শুঁকেছেন, মানুষের সাথে কথা বলেছেন। বিষয়টি এজন্য বলছি যে, কাজী নজরুল ইসলাম কোথাও যাবেন, আর তাঁর সেই যাাত্রা পথে আলোড়ন সৃষ্টি হবে না, সেটি সেই যুগে কল্পনাও করা যেত না। ১৯২১ সালের ডিসেম্বরের শেষদিকে ‘বিদ্রোহী’ লেখার পর কবির নাম সারা ভারতবর্ষের আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। যে পত্রিকাগুলোতে বিদ্রোহী মুদ্রিত হয়েছিল সেইসব পত্রিকার কপি লাখে লাখে বিক্রি হয়েছে। বিজলির মতো পত্রিকা শুধু এই বিদ্রোহী কবিতার জন্য পুনর্মুদ্রণ করতে হয়েছিল। ডঃ আশরাফ সিদ্দিকী ‘যাঁদের দেখেছি’ পুস্তকে লিখেছেন, বিদ্রোহী কবি নজরুল সম্বন্ধে দেশবাসী অন্য সকলের মতো আমাদেরও আবাল্য উৎসাহ ছিল। সর্বদাই ভাবতাম, একবার কবিকে স্বচক্ষে দেখতে পারলে ধন্য হয়ে যাই। তখন আমি পড়ি ময়মনসিংহ জেলা স্কুলে ১৯৩৮ থেকে ’৪২ সনের মধ্যে। ৪১ নম্বর মুকুল মেলা কমিটির তখন আমি সভাপতি। আমার সদস্য নম্বরও ছিল ৪১। এই সময় মোহাম্মদ মোদাব্বের পরিচালিত ‘আজাদের মুকুল মাহফিলে’ কবি নজরুলের ‘মুকুলের উদ্বোধন’ নামে একটি অতি চমৎকার কবিতা প্রকাশিত হল-যা পরে নতুন চাঁদ কাব্যগ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। ঐ কবিতার ক’টি লাইন দিয়েই মুকুলের মাহফিলের সদস্য কার্ড ছাপা হত: “গোলামির চেয়ে শহীদি দরজা অনেক উর্ধ্বে জেনো চাপরাশির ঐ তকমার চেয়ে তলোয়ার বড় মেনো আল্লাহর কাছে চেয়ে না কখনও ক্ষুদ্র জিনিস কিছু আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে কভু শির করিও না নীচু।” মুকুলের মাহফিলের সদস্যরা কবি কাজী নজরুলের কবিতার লাইন তাবিজের মতো গলায় ঝুলিয়ে রাখতেন। ভারতবর্ষের স্বাধীনতাকামী মুক্তিযোদ্ধারা তাঁর কবিতা-গান গেয়ে শক্তি সঞ্চয় করতেন। অনুশীলন, যুগান্তর প্রভৃতি বিপ্লবী সংঘের সদস্য হতে হলে কাজী নজরুল ইসলামের অগ্নি-বীণা মুখস্থ করা লাগত, হৃদয়ে ধারণ করা লাগত। ১৯২২ সালের ১৩ অক্টোবর তাঁর নিজের সম্পাদিত অর্ধ-সাপ্তাহিক ধূমকেতু পত্রিকায় তিনি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়ার পর থেকে তিনিই হয়ে ওঠেন স্বাধীনতাকামী সকলের প্রাণ-পুরুষ। এরকম উদাহরণ দেয়া যাবে অসংখ্য অগণিত। সেই হিসেবে নিশ্চয়ই আজকের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাটিতেও তাঁর পা পড়েছিল, তার গন্ধ-বাতাস তিনি আস্বাদন করেছিলেন।…..(চলবে) লেখক নজরুল গবেষক, সরকারের উপসচিব (প্রতিষ্ঠাতা, নজরুল স্টাডি সেন্টার ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্যানিকেতন, বেড়তলা, সরাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া) লেখকের ইউটিউব চ্যানেল: https://www.youtube.com/user/jehadtax নজরুল স্টাডি সেন্টারে যোগ দিন: https://www.facebook.com/groups/1225632124206211
Comments