top of page

নজরুল সংগীত শিল্পী জুলহাস উদ্দিন আহমেদ।। শামসুল হুদা

নজরুল সংগীত শিল্পী

জুলহাস উদ্দিন আহমেদ

১৯৩৩ -২০২১।


মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ঘাটের পূর্বে ইকরাশীর কাছে ইছামতি নদী ঢাকার দোহার-নবাবগঞ্জ উপজেলার ভেতর দিয়ে মুন্সীগঞ্জ শ্রীনগর সিরাজদিখানের সৈয়দপুরের কাছে গিয়ে ধলেশ্বরী নদীতে মিশেছে। এ নদীটি শ্রীনগর উপজেলার বাড়ৈখালী ইউনিয়নের এবং সিরাজদিখান উপজেলার শেখরনগর ইউনিয়নের পাউসার গ্রামের ইছামতী নদীর পশ্চিম তীরে বাড়ৈখালী বাজারের পশ্চিম দিক প্রবাহিত বাড়ৈখালী খাল নামে বিখ্যাত আড়িয়ল বিলে গিয়ে মিশেছে। বাড়ৈখালী বাজারের ঠিক কয়েক’শ মিটার দক্ষিণে বাড়ৈখালী খালটির পূর্ব পাশে অধুনা বিস্মৃতপ্রায় কিংবদন্তি নজরুল সঙ্গীতশিল্পী জুলহাস উদ্দিন আহমেদের বাড়ি। বাড়িতে এখনও জরাজীর্ণ ব্রিটিশ আমলের প্রায় ১০৫ বছরের একটি একতলা দালান আছে। সেখানে শিল্পী কিশোর যৌবনে বন্ধুদের নিয়ে সঙ্গীতচর্চা করতেন। বন্ধুদের মধ্য ছিলেন মুন্সীগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজের তৎকালীন জিএস আমার আপন বড় ভাই মো. তানজর আলী, নুর আলী (সাবেক এডিএম) আহমদ আলী অধুনালুপ্ত দৈনিক পাকিস্তানের কর্মকর্তা ও আমি। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হলেও শিল্পী আমাকে আদর করতেন। মরমী নজরুল সঙ্গীতশিল্পীর জন্ম শুক্রবার ১০ নভেম্বর ১৯৩৩, বাংলা ২৪ কার্তিক ১৩৪০।


পারিবারিক পরিচয়- শিল্পীর দাদার নাম মরহুম মো. মনসুর উদ্দিন, দাদির নাম মরহুমা আমেনা বেগম, বাবা মরহুম ইয়ার আলী বেপারি, মা মরহুমা হাসনা বেগম, নানা মরহুম ফকির আবদুল কাদের। তারা পাঁচ ভাই। বড় ভাই মরহুম ফরহাদ হোসেন, কুড়িগ্রামের সাবেক এসডিও। যিনি আমাকে এ প্রতিবেদন রচনায় সহযোগিতা করেন। ২) মরহুম আফলাতুন হোসেন, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান, ৩। মরহুম মো. লুকমান হোসেন, সাবেক প্রধান শিক্ষক। ৪) মরহুম গিয়াস উদ্দিন আহমেদ, তিনি একজন ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। শিল্পী মো. জুলহাস উদ্দিন আহমেদ ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। বোন তিনজন; জহুরা বেগম, হাজেরা বেগম ও ছাহেরা বেগম। শিল্পী জুলহাস উদ্দিন আহমেদ চিরকুমার।


তার বাড়ির পুরনো একতলা দালানটির জরাজীর্ণ অবস্থা। তিনি বর্তমানে থাকেন পাশেই পাকা ওয়ালের নতুন টিনের ঘরে। সে বাড়িতে আমি ও আমার ছোট ছেলে উপস্থিত হলাম। জুলহাস উদ্দিনের বড় ভাইয়ের কনিষ্ঠ মেয়ে নাসরিন বেগম ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। জানতে চাইলেন, আমরা কী জন্য এসেছি।


পরিচয় দিলাম, আমি তার ছোট কাকার প্রিয় বন্ধু তানজর আলী মাস্টারের ছোট ভাই মারজান আলী। পাউসার উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। আমি শিল্পীর সাক্ষাৎকার নিতে এসেছি।


শিল্পীর ছোট ভাতিজি নাসরিন বেগম অনুরোধ করে বললেন, স্যার এসেছেন ভালো, কিন্তু ছোট কাকা তো কাউকে সাক্ষাৎ দেন না, সাক্ষাৎকার তো দূরের কথা, তিনি বিরক্ত বোধ করেন। কারণ তিনি কানে শুনতে পারেন না। শিল্পী হিসেবে পরিচয়ই দিতে চান না। তার মনে অনেক ক্ষোভ। ছোট কাকা একা রুমে থাকেন। সেখানেও তার প্রয়োজন ছাড়া আমরা যাওয়া-আসা করি না। বলুন স্যার, আমি এখন কী করতে পারি?


আমি বললাম, তুমি তাকে গিয়ে বল তানজরের ছোট ভাই মারজান মাস্টার এসেছেন।


নাসরিন গেলেন বটে, আবার ফিরে এসে বললেন, শুনুন যদি কাকা সাক্ষাৎ দেন, তখন তাকে কিছু বলতে হবে না তিনি নিজের ইচ্ছায় যা বলবেন তাই আপনাকে শুনতে হবে। আমি আপনাকে সহযোগিতা করব তার কিছু লিখিত ডাটা দিয়ে। আপনার নাম যেন কি?


আমি বললাম নামের দরকার নেই তুমি গিয়ে বল তানজরের ছোট ভাই এসেছেন।


নাসরিন যেতে যেতে বললেন, মনে হয় না সে দেখা দেবেন। তাকে বারবার জিজ্ঞেস করলেও কানে শোনেন না বলে কোনো উত্তর দিতে পারেন না বরং বিরক্ত হন।


তিনি সঙ্গীতশিল্পীর কক্ষে ঢুকে জোরে জোরে বললেন, ছোট কাকা আপনার সঙ্গে পাউসারের তানজেরর ছোট ভাই দেখা করতে এসেছেন।


তিনি বারবার জিজ্ঞেস করলেন, কে? নাসরিন আবার জোরে জোরে বলতে লাগলেন পাউসার গ্রামের আপনার বন্ধু তানজরর ছোট ভাই এসেছেন।


সঙ্গীতশিল্পী অবাক হয়ে হাসতে হাসতে বললেন, বলিস কী! তানজেরর ছোট ভাই মারজান আইছে;


নাসরিন সহাস্যে বলল হ্যাঁ কাকা তিনি এসেছেন।


শিল্পী বললেন, কোথায়?


নাসরিন জানালেন, বারান্দায়। তিনি ব্যস্ত হয়ে বললেন, ওকে আসতে বল। হায়রে এত দিন পর মারজান আমাকে স্মরণ করল। এই বলে শিল্পী নিজেই দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন।


নাসরিন উল্লসিত হয়ে আমাদের কাছে এসে বললেন, স্যার কাজ হয়েছে, আপনি আসুন। কাকা নিজের কথা নিজেই বলতে থাকবেন, বড় একটা জিজ্ঞেস করতে হবে না। আমি কাকার সব তথ্য এনে দিচ্ছি।


আমি বারান্দা থেকে উঠে দেখি তিনি রুমের দরজার সামনে এসে গেছেন। তখন আমিও আমার ছোট ছেলে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলাম।


তিনি বুকে জড়িয়ে ধরে দোয়া করলেন, এসো মারজান আমার বেডরুমে এসো।


আমি তার পাশে বসলাম। নাসরিন একটা পাঞ্জাবি এনে শিল্পীকে পরিয়ে দিলেন।


কাকা আপনার ছবি তুলতে হবে। সানগ্লাসটা পরতে হবে। নাসরিন সানগ্লাস ও পাঞ্জাবিটা পরিয়ে দিলেন।


কথা আরম্ভ হল- নাসরিন যেভাবে বলেছেন, সেভাবেই। শিল্পী বললেন, তো ভাই কেমন আছ। তানজরের সঙ্গে আমার আড্ডাখানা ছিল ওই পুরনো বিল্ডিংয়ে। তুমি আসতে তার সঙ্গে। চুপ করে বসে গান শুনতে। আরও কয়েকজন বন্ধুবান্ধব আসত গান শুনতে। তুমি চুপচাপ গান শুনতে বলে তারা তোমাকে আদর করত। তানজর তো সংস্কৃতিমনা একজন ছাত্র ছিল। কিন্তু আমি ওকে রেডিওতে সঙ্গীত পরিবেশনের জন্য অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু চর্চার অভাবে ওর তাল কেটে যেত। ওকে বলেছিলাম, তুমি ঢাকা আসো, আমি তোমাকে সাহায্য করব। কিন্তু তা আর হল না, গ্রামের স্কুলেই পড়ে রইল। উচ্চাঙ্গসঙ্গীত না হলে তো গান গাওয়া যায় না। তো তুমি এখন কী করছ।


আমি জোরে জোরে বলতে লাগলাম, মাস্টারি করি, গান লিখি, গানের সুর করি আর হারমোনিয়াম নিয়ে নিজেই নিজের গান গাই।


তিনি অবাক হলেন, তুমি গীতিকার, সুরকার, কণ্ঠশিল্পী! সাবাস! আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করলেন বললেন, ভেবেছিলাম মুন্সীগঞ্জে, আমাদের এলাকায় সঙ্গীতের ধারাবাহিকতা থাকবে না। কিন্তু তোমার কথায় প্রাণ ভরে গেল। চেষ্টা চালিয়ে যাও। কেউ বলবে ভালো, কেউ বলবে কিছুই হয় নাই, তুমি এগুলোকে তুচ্ছজ্ঞান করবে। প্রতিভা কার কখন বিকশিত হয়, কাকে কোন শীর্ষে নিয়ে যায় তার তা নির্ভর করে অধ্যবসায় ও চর্চাগুণের ওপর। যদি তুমি পরনিন্দায় কান দাও এতে করে তোমার মন খারাপ হয়ে যাবে। যেমন আমার বেলায়ও এমন হয়েছিল। অনেক বাধা ছিল। আল্লাহর করুণা সারা বিশ্বে ছড়ানো। যে যেটা নিতে পারছে, কর্মগুণে মানুষ এগোতে পারছে। আমি চোখে দেখি না। গানের সম্মান পাই। কিন্তু যে রকম চেয়েছি সে রকম হতে পারেনি। একজন দৃষ্টি প্রবিন্ধীর কাছ থেকে সঙ্গীত প্রতিভা বের হয়ে আসল সেটার দিকে কে নজর দেয়? চ্যানেল আই নজরুল মেলায় আজীবন সম্মাননা দিল। আমার হাতে গড়া অনেক ছাত্রছাত্রী বড় মাপের শিল্পী হয়েছে। এতেই আমি খুশি। আমার সঙ্গীত জীবন ছিল বড়ই কঠিন।


শিল্পী জীবনের গল্প


আমার সঙ্গীত জীবনের কথা একটা গল্পের মতো। তাই শুয়ে শুয়ে ভাবি। কোনোটাই যেন ভাই সহ্য হয় না। যখন আমার বড় ভাই মরহুম ফরহাদ হোসেন কুড়িগ্রামের এসডিও ছিলেন তখন আমার দৃষ্টি আর ভালো হবে না বলে নিশ্চিত হল। কারণ আড়াই বছর বয়সে গুটি বসন্ত রোগে আমার চোখ দুটি নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু গানে আমার কণ্ঠস্বর ভালো বলে তিনি চিন্তা করলেন আমাকে সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে হবে, বাঁচাতে হবে সঙ্গীত দিয়ে। আমার মা-বাবা সঙ্গীতচর্চা করতেন। আমার নানা আবদুল কাদের ফকির যিনি দেহতত্ত্বমূলক সঙ্গীত রচনা করে গাইতেন। সে প্রসঙ্গ সঙ্গীত ম্যাগাজিন সরগমে একবার প্রকাশিত হয়েছিল। তার ছেলে আবদুল আজিজের তত্ত্বাবধানে প্রতিবছর ৯ই ফাল্গুন জাঁকজমকভাবে ওরশ মোবারক অনুষ্ঠিত হতো। আগে যোগ দিতেন তার শিষ্য রজ্জব ও ইজ্জত দেওয়ান আর এখন পরেশ আলীসহ অন্য সঙ্গীতশিল্পীরা আসেন। সে যাই হোক এরপর বড় ভাই আমাকে কলকাতা পাঠান সঙ্গীত প্রশিক্ষণ নিতে। সেখানে আমি শ্রদ্ধেয় চিন্ময় লাহাড়ির কাছে উচ্চাঙ্গসঙ্গীত শিখি। তবে বলা যায়, আমার সঙ্গীতের হাতে খড়ি আমার বড় ভাই মরহুম ফরহাদ হোসেন, মেজ ভাই সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আফলাতনের কাছে। আর চতুর্থ ভাই ইঞ্জিনিয়ার গিয়াস উদ্দিন আমাকে অনেক সাহায্যে করেছেন। আমি ১৯৪৯ সালে কলকাতার বেলে ঘাটায় নারায়ণ মুখোপাধ্যায়ের নামে এক বন্ধুর বাড়িতে থাকি। সেখান থেকে চিন্ময় লাহাড়ি, তারপর তারাপদ চক্রবর্তীর কাছে প্রায় ৫ বছর সঙ্গীতে তালিম গ্রহণ করি। তাদের কাছে উচ্চাঙ্গসঙ্গীত শিখে আমি সঙ্গীতের টিউশনি করতাম। যা পেতাম তা দিয়ে সঙ্গীতচর্চার খরচ চালাতাম। এ এক বড় সাধনা। ১৯৫৫ সালে আমি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আসি। উচ্চাঙ্গসঙ্গীত প্রতিযোগিতায় রাজশাহীতে প্রথম স্থান অধিকার করি এবং স্বর্ণপদকসহ ‘সুর সাগর’ উপাধি লাভ করি। ১৯৫৬ সালে আবার কলকাতায় যাই তখন ওস্তাদ আমির খাঁ ও ওঁঙ্কারনাথ ঠাকুর, ওস্তাদ নিসার হোসেন খাঁ, ওস্তাদ বলে গোলাম আলী খাঁ প্রমুখ গুণীজনের সানিধ্য লাভ করি। ১৯৬৮ সালে আমি ঢাকায় মেজ ভাইয়ের বাসায় থাকি। ১৯৬১ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বেতারে নজরুল ও আধুনিক গান গাই। এর পর আর গান গাই না।


তিনি আপন মনে বলেই চলেছেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ টেলিভিশনে নজরুলসঙ্গীতের আসর পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করি। ১৯৬৫ সালে ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউশন হলে নজরুলসঙ্গীতের রূপকার আঙ্গুর বালা, সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায় ও অঞ্জলি মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে এ দেশের একমাত্র নজরুল সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে নজরুলসঙ্গীত পরিবেশন করি এবং অনেক প্রশংসা অর্জন করি। কিন্তু ১৯৭৫ সালে আমার কণ্ঠস্বর নষ্ট হওয়াতে আর সঙ্গীত জীবনে ফিরে যাইনি।


একজন সঙ্গীতশিল্পীর গুণাবলি


সঙ্গীতশিল্পী হতে হলে কী কী গুণ থাকতে হবে তার কাছে জানতে চাইলে নাসরিনের সহযোগিতায় এ কথাগুলো বের হয়ে আসে।


১। সঙ্গীতশিল্পী হতে হলে অবশ্যই তাকে চরিত্রবান হতে হবে।


২। সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকতে হবে।


৩। নিজ নিজ ধর্ম আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করতে হবে।


৪। নিষিদ্ধ খাবার, পানীয় ও ধূমপান বর্জন করতে হবে।


৫। স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দিতে হবে। প্রয়োজনের চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে সঙ্গীতচর্চা করতে হবে।


৬। অমর আধুনিক বাংলা, লোকসঙ্গীত, হিন্দি বা উর্দু সঙ্গীতগুলো অনুধাবন করার চেষ্টা করতে হবে। যারা নজরুল ও রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখতে ইচ্ছুক তাদের উভয় সঙ্গীতের কম পক্ষে ২৫টি গান নির্ভুলভাবে চর্চা করতে হবে।


৭। উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে অবশ্যই মনোযোগ দিতে হবে।


৮। নিয়মিত ভালো ওস্তাদের কাছে শিখতে হবে। অসৎ সঙ্গ ত্যাগ করতে হবে। জ্ঞানী-গুণী ও বড়দের প্রতি শ্রদ্ধাবান হতে হবে।


৯। কণ্ঠশিল্পীকে সুন্দর বা সুন্দরী হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। তার কণ্ঠস্বর শ্রুতিমধুর ও প্রাণপ্রিয় কিনা শ্রোতার কাছে সেটাই বিচার্য বিষয়।


১০। শিল্পীদের বয়সের কথা আসে, কিন্তু এমনও তো দেখা যায় বা শোনা যায় বয়স্ক শিল্পীরা অনেকেই বিশ্ববিখ্যাত। যেমন; লতা মঙ্গেশকার, আশা ভোশলে, মেহেদী হাসান, আমাদের ফেরদৌসী রহমান, আবদুল হাদী, আবদুল জব্বারসহ আরও অনেকে।


আমি ব্যক্তিগতভাবে জুলহাস উদ্দিন আহমেদের খুবই ভক্ত। পাকিস্তান আমলে তার মায়াভরা কণ্ঠস্বরে গান শোনার জন্য রেডিওর সময়সূচি লিখে রাখতাম। ভারতের মরমী শিল্পী মরহুম তালাত মাহমুদ আর জুলহাস উদ্দিনের প্রায় একই ধরনের কণ্ঠস্বর। কী মিষ্টি মধুর সুর। তার অনেক শিষ্য আছে। আজ তারা বড় মাপের, সমাজের এমনকি দেশ-বিদেশে স্বনামধন্য শিল্পী। আর শিল্পী জুলহাস উদ্দিন শহর ছেড়ে সেই নিজ গ্রামে পুরনো বাড়িতে নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন। নাসরিনকে জিজ্ঞেস করলাম, শিল্পীর বাড়ি মেরামত করা যায় না? নাসরিন বললেন, সে তো অনেক টাকার ব্যাপার!


এ সময় মরমী শিল্পী বলে উঠলেন, একটা বিষয় খেয়াল করো, আমি তো কবি নজরুল ইসলামের গান গেয়ে সম্মান পেয়েছি। আমাদের জতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কত অবদান সে সম্পর্কে তোমাকে কী বলব। তাকে যদি ওই সময় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় কবি না করতেন, জাতীয় কবি হতেন কে? এখন পর্যন্ত তার সমাধিসৌধ হয়নি। তার সঙ্গে তুলনা করলে আমি তো কিছুই না।


আমি বললাম এ প্রসঙ্গে আমি তো আগেও লেখালেখি করেছি। তিনি বললেন, তাতে ফল কী হল? আমি আর কিছু বলতে পারলাম না।


গত ২৩ জানুয়ারি সোমবার সকালে মরমী শিল্পীকে আবার দেখতে যাই। আমার সঙ্গে ছিলেন শিল্পীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. মো. হাসানুজ্জামান বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তা ও বিশিষ্ট সমাজসেবক বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. নাজিম উদ্দিন তালুকদার, বিশিষ্ট সমাজসেবক মো. মঞ্জুর রহমান দেওয়ান এবং আমাদের কম্পিউটার সেন্টারের কর্মকর্তা। ডাক্তার মো. হাসানুজ্জামান শিল্পীকে নিয়মিত চেকআপ করেন।


ডাক্তার সাহেব বললেন, শিল্পীর শারীরিক অবস্থা ঠিক আছে। তবে বয়সের ভারে মাঝে মধ্যে একটু এদিক-সেদিক হয়, আবার ওষুধেই সেরে যায়। প্রেসার ভালো এবং লাঞ্চও ভালো। কানে শুনতে পান না, এটাই তার বড় সমস্যা। হতাশা থেকে নির্জন জীবনযাপন করেন। সঙ্গীতশিল্পীরা সবার আপনজন, তারা কোনো দেশের গণ্ডির মধ্যে থাকেও না। এমতাবস্থায় তাদের সম্মাননা পরিচর্যার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেয়া প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে সরকারের কাছে আমাদের আবেদন থাকবে এ গুণী সঙ্গীতশিল্পীকে তার জীবদ্দশাতেই একুশে পদক দেয়া হলে শেষ জীবনে আত্মতৃপ্তি নিয়ে জাতির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারবেন।


বাড়ৈখালী, শ্রীনগর, মুন্সীগঞ্জের বিশিষ্ট সমাজসেবী মো. মঞ্জুর রহমান দেওয়ান, বলেন, সঙ্গীতযুদ্ধের এক অদৃশ্য শক্তি। এ মরমী সঙ্গীতশিল্পী জুলহাস উদ্দিন অন্ধ হয়েও স্বাধীনতার জন্য তার গানের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করেন। তার সঙ্গী মঞ্জুর রহমান দেওয়ান, মরহুম বশির আহম্মেদ, মরহুম আজাদ খন্দকার, মরহুম আলী হোসেন এবং সঙ্গীতশিল্পী মরহুম আলাউদ্দিন সরদারের মাধ্যমে রণসঙ্গীত রেকর্ড করে ছোট আক্কাসের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে পাঠানো হতো। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে তার রণসঙ্গীত বেজে উঠলে দেশের মুক্তিযোদ্ধা তথা সারা বাঙালি স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য আরও উৎসাহিত ও উজ্জীবিত হয়ে উঠেছিল। ভাষা আন্দোলনে কবি নজরুলের দেশাত্মবোধক গান গেয়ে তিনি ছাত্রছাত্রী ও তরুণদের ভাষা সংগ্রামে অনুপ্রেরণা যোগাতেন।


(সংগৃহীত)

Comentarios


পাঠক নিবন্ধন ফর্ম​

জমা দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ!

লেখা প্রদানের জন্য মেইল করুন

banglakotha2011@gmail.com

©2025 by Banglakotha

Bangladesh

bottom of page