প্রাণনের জীবনাবসান ও নিনির ভূবন।। শাহ জালাল খান
- শাহজালাল খান
- Feb 9, 2022
- 2 min read

যশোরের চিত্রশিল্পী সোহেল প্রাণনের অকাল মৃত্যু ঘটে গেছে গত সোমবার । নিষ্ক্রিয় কিডনি নিয়ে দীর্ঘ চিকিৎসায় জয়ী হয়ে আসার পর অকস্মাৎ অকাল শোকাশ্রু আমাদের । সোহেল প্রাণনের এক ঝলক বালকি মুখ দেখেছিলাম বহুআগে । সেই কিশোরটি পুষ্পিত হয়ে কিছু বিস্ময়কর চিত্রকর্মের জন্ম দিয়েছিল । সে ঘর বেঁধেছিল আমাদেরই এক ছোট বোন স্বান্তনা শাহরিন নিনির সাথে । আমার জীবনে দেখা অসাধারণ কিছু চিত্রকর্মের জনকও এই নিনি । শান্তিনিকেতনের উচ্চশিক্ষা নেওয়া নিনি আর বাংলাদেশের জল , মাটি মানুষের প্রতিকৃতি আঁকা প্রাণন বাস্তবে বাংলা ছবির মায়াবী জগতের মতো যুগল । তাদের চারহাতে ঝরঝরিয়ে সৃষ্টি হয়েছে বাঙালিয়ানার বিমূর্ত – মূর্ত যত সৃষ্টিকর্ম ।

সোহেলের ছবির সাধারণ পাঠ থেকে যতটুকু বুঝেছি , তার ছবি গুলো সুলতান প্রভাবিত হলেও সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ভাব-মণ্ডলের । সুলতানের বাঙালি প্রকৃতপক্ষে অতি বাঙালি , অতি শক্তিশালী ও মাত্রাতিরিক্ত পেশিবহুল , যার মধ্যে আছে সুলতানের কামনা মাখা কল্পিত বাঙালির ছায়া । সোহেলের বাঙালি, অধুনা বাঙালির মতো সুঠাম । বাস্তব বাঙালির কায়ায় যেন মায়া মাখানো । তাঁর ছবির চকচকে চোখ গুলো অদ্ভুত কিছু বার্তা দিতে তাকিয়ে থাকে । সুলতানের বিখ্যাত ছবি আদমের পিঠের দুপাশে উড়ন্ত নারী , কিংবা লা প্রিমাভেরার মায়াবি জগতের উড়ন্ত শিশুর উপস্থিতি রয়েছে প্রাণনের ছবিতে। লাস্ট জাজমেন্টে , কিংবা দ্য স্কুল অফ এথেনার অতি জীবন্ত কিন্তু জটিলিকরণ থেকে সরলীকরণের প্রতিচ্ছবির মুগ্ধতা পাওয়া যায় প্রাণনের ছবিতে ।

শাiহরিন নিনির ছবির যথাযথ পাঠ নিতে গেলে গভীর অনুধ্যান প্রয়োজন । তার ছবি গুলো আমাদের মূর্ত ভাবনার মধ্যে বিমূর্ততার জগতে বুঁদ করে রাখে । ঢাকা এবং যশোরের প্রদর্শনীতে যত্ন ও আতিথেয়তার পরিবেশে প্রদর্শিত ছবিগুলো দেখে আমার মনে হয়েছে এ এক ভিন্নজগতের ছোঁয়া । সে ছোঁয়া কখনো চোখের পুলকে , কখনো মনের গহীনে , কখনো তন্দ্রাচ্ছন্ন বিমুগ্ধতায় মোড়ানো । এই শিল্পী দম্পত্তির ঢাকার নিবাসে দেখেছি আর এক রঙিন ভূবন । কোথাও একচিলতে আসবাবের জায়গা নেই । দেওয়াল ,সিঁড়ি, বিছানা , ঘরের কোণ , খাটের তলে মহা মূল্যবান ছবিগুলো যত্রতত্র ছড়ানো ছিটানো । নিনির ছবিগুলো দেখা মাত্র বিখ্যাত শিল্পীদের আঁকিয়ে হাতের ছোঁয়া বলে মনে হয় । ছবিগুলো যদি রক্ষণাবেক্ষণে সুন্দর একটি সুযোগ পায় , তবে তা কেবলই কাল থেকে কালান্তরের গর্ভে জীবন্ত হওয়ার অপেক্ষা করছে মাত্র । সোহেল প্রাণনের শেষ ইচ্ছা ছিল তাদের বিস্তুৃত বসত ভিটার শেষ প্রান্তে বটবৃক্ষের নিচে তার অন্তিম শয়নটি হোক, আর পৈত্রিক ভিটায় নিজের অংশিদারিত্বের অংশে তার সংগ্রহশালাটি স্ত্রীর হাতে আরো সম্প্রসারিত হয়ে সেখানে তাঁর চিত্রকর্মগুলো শোভা পাক । স্ত্রী ও মায়ের কাছে এই আবদারটি করে গেলেও পারিবারিক বিড়ম্বনায় সেটি সম্ভব হয়নি । পরিবারের একগুঁয়ে সিদ্ধান্তে তাকে সরকারি কবরস্থানে যেতে হয়েছে । ধর্ম ও আইন মানা মানুষ গুলো তাঁর সহধর্মীনির মর্মন্তুদ আর্তনাদে কর্ণপাত করেনি । সোহেলের সৃষ্টিগুলো এখন উদ্বাস্তু ঠিকানাহীন হয়ে অগস্ত্যযাত্রার আশঙ্কা নিয়ে পত্নী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষিকা নিনির পিঠে সওয়ারী । নিনির মনোজগতের ক্যানভাসে যে আগামীদিনের জীবন্ত সৃষ্টিকর্মগুলো অমরত্বের দাবি নিয়ে জন্মগ্রহণ করবে , সেই সৃষ্টির আবাসন সংকটের তীব্র যন্ত্রণার পাশে এই ভার তারজন্য কতটুকু সহনশীল ! শিল্পপূজ্য পরিবার, শিল্পবোধ্যা সমাজ, শিল্পের কদরি বিত্তবানেরা আমাদের অভিজাত শিল্পকর্মগুলো প্রজন্মের জন্য বাঁচাতে না এলে এদেশে আর শিল্পীরা কখনো জন্মগ্রহণ করবে না । সোহেলের জানাজা থেকে ফিরে আমার বলতে ইচ্ছে হচ্ছে , প্রাণনের ছিল , আর নিনির আছে গিজগিজে ফরাসি মেধা -মগজ । এই ফরাসি মেধা নিয়তির ফাঁদে বাঙালির আত্মা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে শিল্পের কদরহীন সমাজে কেন ডুঁকরে কাঁদতে এলো ! ৯ ফেব্রুয়ারি , ২০২২ বুধবার , চিত্রার পাড় থেকে ।
লেখক: সহযোগী সম্পাদক, মাসিক বাঙলাকথা
Comments