বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হলো: ‘নজরুল সংগীত : বাণীর বৈভব’
- আমিনুল ইসলাম
- Oct 12, 2021
- 7 min read
আমিনুল ইসলাম

আজ ১১ অক্টোবর ২০২১ আমার ক্ষুদ্র লেখকজীবনে একটি বড় আনন্দের দিন। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হলো আমার লেখা বই: ‘ নজরুল সংগীত : বাণীর বৈভব’। ৪৫৪ পৃষ্ঠার বইটি আজ আমার হাতে তুলে দেন বাংলা একাডেমির সম্মানিত মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। উপস্থিত ছিলেন বইটি প্রকাশনার সাথে আগাগোড়া প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত বাংলা একাডেমির পরিচালক নুরুন্নাহার মুক্তা; উপস্থিত ছিলেন বাংলা একাডেমির উপরিচালক কবি-গবেষক ড. তপন বাগচী, কথাশিল্পী ঝর্ণা রহমান, কবি বীরেন মুখার্জী এবং বাংলা একাডেমিতে কর্মরত লেখক-গবেষক জনাব মোকারম হোসেন। আমি বহুবার বলেছি যে আমি সংগীতপাগল মানুষ। জীবনে খুব কম দিন গেছে যেদিন আমি একটি গান শুনিনি কিংবা একা একা গুনগুনাইনি। সব ধরনের গানই আমার পছন্দ—গজল-আধুনিক-লোকগীতি-সিনেমার গান-কাওয়ালী-ইসলামী গান-শ্যামাসংগীত-কীর্তন-আলকাপ-ধামাল-ঝুমুর এবং আরও কত ! সব ধরনের বাংলা গান শুনি: তার সাথে হিন্দি-উর্দু-আরবি-ইংরেজি গান। তবে আমার সবচেয়ে বেশি পছন্দের জায়গাটি হচ্ছে নজরুল সংগীত। আমি একজন শ্রোতামাত্র। তবে একনিষ্ঠ শ্রোতা; প্রেমিক শ্রোতা। বইটিতে আমি গানের সুর নিয়ে লিখিনি। সেই সাধ্য আমার ছিল না। আমি লিখেছি নজরুলের গানের ভাবসম্পদ নিয়ে যাকে আমি বলতে চেয়েছি বাণীর বৈভব। সূচিপত্র নিম্নরূপ:
প্রথম অধ্যায়
ক.নজরুলসংগীতের বাণীর বৈশিষ্ট্য;
খ.নজরুলের গানে শব্দের ব্যবহার;
গ.নজরুলের সৌন্দর্যচেতনা : প্রসঙ্গ গান;
ঘ.নজরুলসংগীতের চিত্রকল্প : ছবির অধিক ব্যঞ্জনা
ঙ. আধুনিকতা ও নজরুলসংগীত;
চ.নজরুলসংগীতে নিসর্গের ছবি ও সুর;
ছ.নজরুলের গানে অখ্যাতজন;
জ.নজরুলের গানে নারী;
ঝ.নজরুলের গানে পুরুষের কান্না;
ঞ.নজরুলের প্রেমের গান: ভাব ও ভাষা;
ট.নজরুলের গানে ঝড়: বিপ্লব ও প্রেমের প্রতীক;
ঠ.নজরুলের প্রকৃতি প্রধান বর্ষার গান;
ড.নজরুলের প্রেমপ্রধান বর্ষার গান;
ঢ. নজরুলের বসন্তের গান:
এক পাত্রে প্রকৃতি ও মানবমন;
ণ.নজরুলের গান : সুরভিত ফুলবাগান;
ত.নজরুলের গান: অনুষঙ্গ যখন নদী;
থ.নজরুলের ইসলামী গান;
দ.নজরুল রচিত সনাতন ধর্মীয় সংগীত;
ধ.নজরুল রচিত মহামিলনের গান;
ন.নজরুলের বীররসের গান: সুর ও বাণীর অগ্নিবীণা;
প.নজরুলের গানে বাংলাদেশ;
দ্বিতীয় অধ্যায়
ফ.নজরুলসংগীত : বাণীর বৈভব;
ব. নজরুলের গানের নেতিবাচক সমালোচনা;
ভ. নজরুলসংগীতের বাণীর বিকৃতি।
২। আমরা জানি, কবিতা আর গান হুবহু একজিনিস নয়। কবিতা মূলত বক্তব্যপ্রধান এবং তার শৈলী যুগসাপেক্ষভাবে তৈরী। রোমান্টিক, আধুনিক, উত্তরাধিুনক, উত্তর-উপনৈবিশক, প্রতীকী, পরাবাস্তব প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের কবিতা আছে। এক ধরনের কবিতার নির্মাণশৈলী এক এক রকমের। তবে প্রায় সব ধরনের কবিতাতেই বাণীর কাজ অর্থময়তা সৃষ্টি করা। এই অর্থময়তা কখনো আক্ষরিক, কখনো প্রতীকী, কখনোবা ব্যঞ্জনাধর্মী। কবিতার সৌন্দর্য মূলত তার ছন্দ, উপমা, চিত্রকল্প, উৎপ্রেক্ষা, পরিহাস, স্যাটায়ার, গঠনসংহতি এসবের ওপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে সংগীতে বাণী ও সুরের সমন্বয় মূলকথা। যদিও বাংলাগান মূলত বাণীপ্রধান ধারায় প্রবাহিত হওয়ার পক্ষপাতী, তথাপি এটাই সত্য যে সংগীতে সুরের ভূমিকা বেশি। আমরা যদি যন্ত্রসংগীতের কথা বলি, বাঁশের বাঁশি বা সানাইয়ের কথা বলি, সেখানে বাণী অনুপস্থিত কিন্তু সংগীত হিসেবে সেসব বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত ও নন্দিত। একাট রাগ বা রাগিনীর ওপর ভিত্তি করে পরিবেশিত সরোদ বা সানাই বা সেতার বাদন সংগীত হিসেবে বিনাতর্কে গৃহীত। অর্থাৎ বাণী ছাড়াও সংগীত স্বয়ংসম্পূর্ণতা পেতে পারে। বাংলা গানে কাজী নজরুল ইসলাম সর্বপ্রথম সুরের প্রাধান্য সৃষ্টি ও প্রতিষ্ঠা করেন। সাধারণত তিনি আগে সুর সৃষ্টি করতেন , তারপর সুরের ওপর কথা বসাতেন। সে হিসেবে নজরুলসংগীতকে সুরপ্রধান সৃষ্টি বলা যেতে পারে। এবং সেটা অগ্রহণযোগ্যও নয়। বেশিরভাগ সংগীত বিশারদই রবীন্দ্রনাথের গানকে বাণীপ্রধান এবং নজরুলের গানকে সুরপ্রধান বলে অভিহিত করে
আসছেন। কিন্তু কিছু কিছু সংগীত সমালোচক অত্যন্ত অন্যায্যভাবে এবং হীনমানসিকতা থেকে নজরুলের গানের বাণীকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে থাকেন। তারা বলতে চান, নজরুলের গানের বাণী কাব্যময় নয়, তাদের ভাষায় তরল বা নিম্নমানের। এবং ফলে নজরুলসংগীত নিম্নমানের গান। এ অভিযোগটি অসত্য এবং অন্যায়। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে নজরুলের গানে সুরের কারুকাজ, বৈচিত্র্য এবং দাপট বেশি।সেটা অন্য কবি-গীতিকারের গানের সুরের সাথে তুলনা করলে অবশ্যই সত্য। কিন্তু নজরুলের গানের বাণীও অত্যন্ত সমৃদ্ধ। নজরুল শক্তিমান কবি ছিলেন বলে তাঁর হাতে রচিত গানের বাণীও কবিতার বৈশিষ্ট্য ও ঐশ্বর্য পেয়েছে।
৩। গানে কথা বা বাণীর ভূমিকা কি হওয়া সমীচীন এ নিয়ে মতভেদ আছে। পারস্যের গজলে সুরের ভূমিকা প্রবল কিন্তু সেসবের বাণীও অসাধারণ কাব্যময়। রুমি, হাফিজ, খৈয়াম প্রমুখ জগতখ্যাত কবিদের রচিত পারসিয়ান গজলগুলো শব্দের অতিরিক্ত রাহসিক ব্যঞ্জনায় এবং অর্থের বহুমুখিনতায় গভীর কবিতার পর্যায়ভুক্ত। রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির গানগুলোও গভীর কবিতার পর্যায়ভুক্ত। আবার বর্তমান সময়ের পাশ্চাত্যের গান মূলতই যন্ত্রসংগীতময় যেখানে বাণীর বৈভব মুখ্য নয় মোটেও। ভারতীয় উপমহাদেশে উত্তরভারতীয় সংগীতে সুরের ভূমিকা নিয়ামক আসনে অধিষ্ঠিত কিন্তু বাংলা গানে যুগপরম্পরায় বাণীর প্রাধান্য বেশি ছিল। রবীন্দ্রনাথের গান তো মূলতই কবিতা। সুর ফ্রেম-বাঁধা। তিনি গানের বাণীর প্রাধান্যের পক্ষে কথা বলেছেন বহু স্থানে কিন্তু সেই দাবিতে সবসময় অটল থাকেননি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘‘ কিন্তু যে-মতটিকে তখন এত স্পর্ধার সঙ্গে ব্যক্ত করিয়াছিলাম সে-মতটি যে সত্য নয়, সে-কথা আজ স্বীকার করিব। গীতিকলার নিজেরই একটি বিশেষ প্রকৃতি ও বিশেষ কাজ আছে। গানে যখন কথা থাকে তখন কথার উচিৎ হয় না সেই সুযোগে গানকে ছাড়াইয়া যাওয়া, সেখানে সে গানেরই বাহনমাত্র। গান নিজের ঐশ্বর্যেই বড়ো; বাক্যের দাসত্ব সে কেন করিতে যাইবে। বাক্য যেখানে শেষ হইয়াছে সেইখানে গানের আরম্ভ। যেখানে অনির্বচনীয় সেইখানেই গানের প্রভাব। বাক্য যাহা বলিতে পারে না গান তাহাই বলে। এইজন্য গানের কথাগুলোতে কথার উপদ্রুব যত কম থাকে ততই ভালো। হিন্দুস্তানী গানের কথা এতই অকিঞ্চিৎকর যে, তাহাদিগকে অতিক্রম করিয়া সুর আপনার আবেদন অনায়াসে প্রচার করিতে পারে। এইরূপে রাগিণী যেখানে শুদ্ধমাত্র স্বররূপেই আমাদের চিত্তকে অপরূপ ভাবে জাগ্রত করিতে পারে সেইখানেই সংগীতের উৎকর্ষ।’’ কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এর বিপরীত কথাও বহুবার বলেছেন এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে তাঁর গানেও বাণীর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেজন্য রবীন্দ্রভক্তরা গানে বাণীর সর্বময় প্রাধান্যের পক্ষে কথা বলে এসেছেন। কিন্তু গানের বাণী কেমন হওয়ার কথা?
৪। গানের বাণী কেমন হওয়া প্রয়োজন, এ বিষয়ে কিছুটা মতভেদ থাকলেও একথা অস্বীকার করা অযৌক্তিক যে-- গানের বাণী কবিতাধর্মী হলেও তা হুবহু কবিতার মতো হবে না। কবিতার একমাত্র লক্ষ্য কোনো অনুভব, অনুভূতি, কল্পনা বা অভিজ্ঞতাকে বোধগম্য ভাষায় উপস্থাপন করা। কবিতার নিজস্ব শৈলী আছে যা তার নান্দনিকতার দিকটিকে নিশ্চিত করে। কবিতায় ছন্দ আছে, অনুপ্রাস আছে, উপমা আছে, উৎপ্রেক্ষা আছে, শব্দের অতিরিক্ত ব্যঞ্জনা আছে। পাঠককে নান্দনিক রস সরবরাহ করার ক্ষেত্রে এসব অলংকার সহায়তা করে থেকে।
৫। গানের বাণী প্রায়ই কবিতার মতো ঢঙে রচিত এবং সেজন্য তা সাধারণত গীতিকবিতা নামে পরিচিত। কিন্তু গান সবখানি কবিতা নয়; গান খানিকটা কবিতা এবং বাকিটা তার অতিরিক্ত কিছু। বাণী সুরের ডানায় উড়লে বা উড়তে পারলে তবে তা গানে উন্নীত হয়। কবিতার জন্য ওড়ার কোনো শর্ত নেই, ওড়া তার কাজও নয়। বরং অর্থের ভার বেশি হলে তার পক্ষে ওড়া সম্ভব নয় এবং তখন তা গানে উন্নীত হতেও পারে না। তার মানে এই যে-- গানের বাণী এমন হওয়া সমীচীন যাতে তা অনুূুভূতি বা ভাবপ্রকাশের সহায় হয় এবং সুরের পাখায় ভর করে উড়ে যেতে পারে। এখানে মাত্রার ব্যাপার আছে, পরিমাণের ব্যাপার আছে। নজরুলের পূর্ব পর্যন্ত বাংলা গান বাণীপ্রধানই ছিল। বাংলা গানের গীতিকার-কবিগণ শুধু সংগীতের রস সৃষ্টির জন্যই গান রচনা করতেন না, গানের মাধ্যমে সমাজ সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে তাদের ভাবনা, মত, সমালোচনা, সমর্থন, ভবিষ্যতচিন্তা প্রভৃতি তুলে ধরাই তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল। সামাজিক কুসংস্কার, প্রথা, ধর্ম, নারীস্বাধীনতা, ঐশ্বরিক প্রেম, মানবীয় প্রেম, দেশের স্বাধীনতা-পরাধীনতা, প্রকৃতিক দুর্যোগ প্রভৃতি নানাবিধ বিষয় উপস্থাপন করতে গিয়ে তারা গানের আশ্রয় নিতেন। একারণেই যুগ-যুগান্তরের বাংলা গান সমাজের-রাষ্ট্রের-জাতির-জনগণের অবস্থার ও যাপিতজীবনের বহুমাত্রিক প্রতিচ্ছবি হয়ে রয়েছে। সেকারণেই বাংলাগান বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ, কখনো তা লোকসাহিত্য নামে, কখনোবা লোকসংস্কৃতি নামে পরিচিতি লাভ করেছে। এককথায় বলতে গলে বলতে হয় যে, হাজার বছরের বাংলা গান বাঙালির আনন্দগ্রহণের শ্রবণ-উপকরণ হওয়ার পাশাপাশি তার জীবনাল্লেখ্যও হয়েছে।
৬। নজরুল বাংলাভাষায় বহু প্রকার গানের প্রবর্তক অথবা প্রধান পুরোধা। গজল, মার্চসঙ্গীত, ইসলামী গান, বীররসের গান, রাগপ্রধান গান, আধুনিক গান নজরুলই প্রবর্তন করেছেন। আবার তাঁর রচিত শ্যামসংগীত, দেশাত্ববোধক গান, লোকসংগীত, হাসির গান, শিশুসংগীত-----আলাদা বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। আর এত ধরনের গান রচনা করতে গিয়ে নজরুল সুরের বৈচিত্র্যের পাশাপাশি বাণীর ঐশ্বর্য সংযোজন করেছেন। নজরুলের গানে দেশিবিদেশি শব্দের ব্যবহার, অভিনব উপমা, চিত্রকল্প, উৎপ্রেক্ষার সংযোজন নজরুলসংগীতে বাণীকে মহিমাময় কাব্যিক ঐশ্বর্য দান করেছে। নজরুলের প্রচুর গান আছে যেগুলো শুধু কবিতা হিসেবে পাঠ করলেও পাঠকের আনন্দ ও বিস্ময়ের সীমা থাকে না। নজরুল তাঁর কবিতা-রচনায় অনেক সময় প্রগল্ভ, অতিকথন দোষে দুষ্ট। কিন্তু তিনি গান রচনাকালে দারুণভাবে সংহত, মিতবাক, সংযমী এবং নান্দনিক ভারসাম্য বিষয়ে সচেতন ও যত্নবান। তাঁর কোনো কোনো গান কবিতা হিসেবে হীরকখন্ড। আর প্রকরণ-উৎকর্ষেই নয়, বক্তব্যের গভীরতায় ও বহুমাত্রিকতায় গানগুলি খুবই সমৃদ্ধ। তাঁর গানের বাণী পাঠ করে তাঁর নারীভাবনা, মানবপ্রেম, প্রকৃতিপ্রেম, স্বাধীনতাপ্রিয়তা, সৌন্দর্যচেতনা, বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধ, শান্তিপ্রিয়তা, সংগ্রামশীলতা, উপনিবেশবাদবিরোধিতা, শোষণবিরোধিতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পক্ষাবলম্বন, প্রেমভাবনা, আধুনিক মানসিকতা প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে সম্যকভাবে ধারণা লাভ করা সম্ভব। নজরুল যে তাঁর সাংগীতিক সাধনায় বাংলা সংগীতের পাশাপাশি বাংলা সাহিত্য ও ভাষাকে কি অপরিমেয় ঐশ্বর্য দিয়ে গেছেন, নজরুলের গানগুলো পাঠ ও বিশ্লেষণ করলে তা আঁচ করা সম্ভব। আসলে সংগীতকার নজরুলকে ভালোমতো পাঠ করা ছাড়া প্রকৃত নজরুলকে সম্যকভাবে জানা অসম্ভব ব্যাপার। কবি নজরুল আর গীতিকার নজরুল একই পাতার দুটি পৃষ্ঠা। তাই তাঁকে পূর্ণভাবে জানতে হলে একই সাথে তাঁর অন্যান্য সৃষ্টির সাথে গানগুলোও সমান গুরুত্বে অবশ্যপাঠ্য। আর যদি শুধু তাঁর গানের কথাই আলাদাভাবে বিচার করি, আমার বিবেচনায় তা হচ্ছে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ সমুদ্র। এই সৃষ্টির মাহাত্ম্য এবং এর স্রষ্টার বিশালত্ব সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণালাভ করার জন্য এই সমুদ্রভ্রমণ অপরিহার্যভাবে আবশ্যক। আমি সংগীতবিশারদ নই বলে নজরুল-সংগীতের সুরসমুদ্র নিয়ে কথা বলার সাহস করিনি। নজরুল-সংগীতের বাণীর ঐশ্বর্য সম্পর্কে কিছু বলার চেষ্টা করেছি গ্রন্থে উপস্থাপিত রচনাবলিতে। আলোচক হিসেবে আমার দৃষ্টিভঙ্গি মূলত কাব্যসমালোচকের দৃষ্টিভঙ্গি। এ দৃষ্টিভঙ্গি সংগীতজ্ঞের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে নাও মিলতে পারে। অবশ্য তা নিয়ে আমি চিন্তিও নই।
নজরুলের গানের সামগ্রিক মূল্যায়নের জন্য এমনসংগীত বিশারদের প্রয়োজন যিনি একইসঙ্গে সুর ও কবিতার ভাবব্যঞ্জনার ওপর সমান দখলের এবং বিশ্লেষণ ক্ষমতার অধিকারী। নজরুলের গান নিয়ে এযাবৎ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গ্রন্থ রচিত হয়েছে। সেসব গ্রন্থের বেশ কয়েকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে এটাও ঠিক যে নজরুলের গানের সুর নিয়ে যতটুকু আলোচনা হয়েছে, তাঁর গানের বাণী নিয়ে ততটুকু হয়নি। আর এর পেছনে কারণটা হচ্ছে গানের বাণী নিয়ে আলাদা করে আলোচনার আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে কি না তা নিয়ে সংশয়। গান তো গেয়ে এবং উপভোগ করে বিচারের জিনিস! তো গানের বাণী নিয়ে আলোচনা কি কাজে দেবে ! আবার সুরের ওপর দখল না থাকলে বাণী নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আলোচনায় ব্যর্থতাগর্ভ সীমাবদ্ধতা রয়ে যাওয়ার ঝুঁকিটাও বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আরেকটি কারণ এই যে প্রচলিত ধারণা হলো নজরুলের গান সুরপ্রধান বলে তাঁর গানের বাণী নিয়ে আলোচনার তেমন কোনো আবশ্যকতা নেই।
৭। এতসব সীমাবদ্ধতা ও ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও আমি নজরুলের গানের বাণী নিয়ে আলোচনার দুঃসাহস করেছি। আমার এই দুঃসাহসের পেছনে কিংবদন্তীতুল্য নজরুলসংগীত শিল্পী ফিরোজা বেগমসহ অনেক বিখ্যাত শিল্পীর গাওয়া গান এবং প্রখ্যাত নজরুলসাধক অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের উপস্থাপনায় টেলিভিশনে পরিবেশিত নজরুলসংগীত বিষয়ক অনুষ্ঠানাদি দুর্বার প্রেরণা ও প্ররোচনা জুগিয়েছে। খ্যাতিমান সংগীত বিশেষজ্ঞ-গবেষক-লেখক করুণাময় গোস্বামীর নজরুলসংগীত এবং রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে অজস্র লেখা পড়ে গভীরভাবে উৎসাহিত বোধ করেছি। প্রখ্যাত নজরুল-গবেষক জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম আমাকে অনেক উৎসাহ দিয়েছেন, মূল্যবান পরামর্শ রূপদান করেছেন। বহু প্রখ্যাত নজরুল গবেষকের বই এবং আর্টিকেল আমাকে সহায়তা দিয়েছে। সেসবের উল্লেখ আছে প্রতিটি লেখাতেই। আমার বহু সহকর্মী এবং লেখক-বন্ধু পরামর্শ ও সহযোগিতা দিয়ে লেখাগুলোকে বই আকারে প্রকাশ উপযোগী করে তুলতে পথ দেখিয়েছেন। তাদের সবার নাম নিতে গেলে লেখার কলেবর বিশাল হয়ে যাবে। আমার জীবনসঙ্গিনী রোকশানা পারভীন লীনা সংসারের প্রায় সমস্ত দায়ভার নিজকাঁধে তুলে নিয়ে আমাকে লেখালেখির নিরুপদ্রব সুযোগ করে দিয়েছেন, আমার প্রায় প্রতিটি লেখার বিষয়ে তিনি মতামত দিয়েছেন। তাঁর ঋণ শোধ করার সামর্থ্য আমার নেই। আর তাঁর ভালোবাসার কাছে চিরঋণী থাকতেও আমার কোনো লজ্জা নেই। আমাদের দুই সন্তান লুবনা এবং সজন সবসময় আমার লেখালেখিকে আনন্দের সাথে গ্রহণ করেছে। আমি লেখক হই, এটা তাদের চাওয়ার সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় আমার জন্য কাজ করার পরিবেশটা অনেক বেশি অনুকূল ও উৎসাহব্যঞ্জক হয়েছে।
৮। বাংলা একাডেমি আমার পাণ্ডুলিপিটি বই অকারে প্রকাশ করায় একাডেমির সম্মানিত মহাপরিচালক শ্রদ্ধেয় কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা এবং সেই সাথে প্রকাশনা বিভাগের সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। পরিচালক নুরুন্নাহার মুক্তা বইটি প্রকাশের জন্য নিরবচ্ছিন্ন ও ধারাবাহিক শ্রম দিয়েছেন। নিষ্ঠার সাথে পরিশ্রম করেছেন কবি মতিন রায়হান এবং গবেষক-লেখক মোকারম হোসেন। বাংলা একাডেমির সচিব কবি হাসনাত লোকমান বইটি প্রকাশনা সংক্রান্ত কাজ তত্ত্বাবধান করেছেন। বাংলা একাডেমির উপ-পরিচালক আমার কবি-বন্ধু ড. তপন বাগচী সবসময়ই আমার পাশে থাকেন; সাথে থাকেন। একাজেও সেভাবেই ছিলেন । তাঁদের সবার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ ও ভালোবাসা । বাংলা একাডেমির প্রাক্তন মহাপরিচালক জনাব শামসুজ্জামান খান এবং কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর সময়ে পাণ্ডুলিপি গৃহীত হয়েছিল এবং প্রকাশের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তাঁদের প্রতিও আন্তরিক কৃতজ্ঞতা রইলো।
‘নজরুল সংগীত : বাণীর বৈভব’ বাংলা একাডেমির বিক্রয় কেন্দ্রে পাওয়া যাবে। বইটি নজরুল সংগীত শিল্পী এবং নজরুল সংগীত শ্রোতাদের ভালো লাগবে বলে আমার গভীর বিশ্বাস।
Comments