মেয়েদের পায়ে ফুটবল।। আমিনুল ইসলাম
- আমিনুল ইসলাম
- Sep 22, 2022
- 3 min read

কাজী নজরুল ইসলাম কেন আমাদের জাতীয় কবি? কারণ একটি জাতির মানুষের মধ্যে যত শ্রেণির মানুষ আছে, নজরুল সকল শ্রেণির মানুষের মুক্তির জন্য প্রত্যক্ষভাবে কথা বলেছেন, কলম ধরেছেন। তিনি নারীদের উদ্দেশ্যে বলেছেন,
"সে যুগ হয়েছে বাসি
যে যুগে পুরুষ ছিল নাকো দাস
নারীরা আছিল দাসী।"
তিনি আরও বলেছেন,
"সেদিন সুদূর নয়,
যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে
গাইবে নারীরও জয়।"
তিনি নারীদের জাগাতে এবং আত্মবিশ্বাস জোগান দিতে লিখেছেন অগ্নিমন্ত্রতুল্য গান : “ জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা’’। আর সমানতালে বেগম রোকেয়া লিখেছেন নারীদের শিক্ষিত, স্বাবলম্বী ও স্বাধীন হওয়ার হাজারো বাক্য। তাঁর এক একটি বাক্য নারীদের জাগিয়ে তোলার এক একটি অমোঘ মন্ত্র, অব্যর্থ অস্ত্র।
আজ সারা দেশ নারীর জয়গান গাইছে; তাদের সংবর্ধনা দিচ্ছে। পুরুষতন্ত্রের চেয়ে খারাপ আর কোনো তন্ত্র নেই। পুরুষতন্ত্রের অস্ত্র রাষ্ট্র, পুঁজিবাদ, ধর্ম, মৌলবাদ, ব্রাহ্মণ্যবাদ, আধুনিকতা, প্রগতিশীলতা, মুক্তবাজার অর্থনীতি, সিনেমা, সাহিত্য, সংগীত, বিবাহ, পরিবার প্রথা সবকিছুই। আদি ও আধুনিক সর্বমুখী সর্বগ্রাসী প্রতিকূলতার মাঝে নারীজাতির বসবাস; এটা বাঘ, সিংহ, হায়েনা, শিয়াল অধ্যুষিত জঙ্গলের মাঝে হরিণের বসবাসের মতন। সকল ধর্মের মৌলবাদীদের কাছে নারী ভোগ্যবস্তু তবে তাদের ঘরের মধ্যে বন্দি রেখে, প্রয়োজনের কালো কাপড়ে ঢেকে রেখে নারীর সবখানি অস্তিত্ব। আর প্রগতিশীলদের কাছেও নারী ভোগ্যপণ্য-- তবে তাকে নগ্ন দেখে বেশি মজা পায়--তাকে " Sexy " দেখতে পছন্দ করে । উভয় গ্রুপই নারীর বিকশিত ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বকে ভয় পায় এবং নানা ফন্দি ফিকিরে বিরোধিতা করে। মৌলবাদীদের বিরোধিতা মূর্খতায় প্রকাশ্য ও অসভ্য; প্রগতিবাদীদের বিরোধিতা ধূর্ত, কৌশলময় ও পালিশ করা । চূড়ান্ত বিচারে পুরুষতন্ত্রের পুরুষ কখনোই নারীর বন্ধু নয়; নারীর বন্ধু শুধু মাত্র নারী। ব্যতিক্রম যা আছে তা ব্যতিক্রমই। যেমন বিদ্রোহী কবি ছিলেন উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। রামমোহন রায় এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও অনেকটাই সেই উজ্জ্বল ব্যতিক্রম ছিলেন।
নারীজাতির মুক্তি, ক্ষমতায়ন, স্বাধীনতা এসব গালভরা কথা আর ভাষণ বাস্তবে কোনো কাজে আসে না। নারীকে যুদ্ধ করে প্রতিকূলতা জয় করতে হয় যাতে প্রতিকূলতা তার জন্য একসময় অনুকূল হয়ে ওঠে। নারী যতদিন তার সম্মান, স্বাধীনতা, ক্ষমতা, সমমর্যাদার জন্য পুরুষের দয়ার দিকে তাকিয়ে থাকবে, ততদিন অবধি তার অর্জন থাকবে শূন্য। নারীরা নিজে চেষ্টা করে সাধনা করে সাহসী হয়ে “ সাফল্য অর্জন’’ করলে তখন পুরুষরাও হাততালি দিবে, সংবর্ধনা দিবে, স্বীকৃতি দিবে, নারীর জয়গানও ‘‘গাহিবে’’।
সাফ নারী ফুটবল প্রতিযোগিতা সেই কথা নতুন করে মনে করিয়ে দিল। অপরাজিত অবস্থায় ফাইনালে ওঠার পরও বাফুফে সভাপতি নেপাল যাননি। কারণ তিনি পুরুষ। তার কাছে মেয়েদের ফুটবল কোনো গুরুত্ব পায়নি। কিন্তু তারা যখন অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়ে দেশের সকল স্তরের মানুষের অভূতপূর্ব ভালোবাসা আর অভিনন্দন এর জোয়ারে ভাসলো, যখন মন্ত্রী সচিব নিজেরা বিমানবন্দরে তাদের সংবর্ধনাসহ রিসিভ করতে গেলেন, তখন বাফুফে অগত্যা তাদের বাফুফে অফিসে নিয়ে গিয়ে সংবর্ধনা দিতে বাধ্য হলো। তবু সেভাবেই সেটাও একধরনের জয়ই হলো মেয়েদের। জয় হলো নারীজাতির। আর বাফুফের নেতারা যে কোচকে " মহিলা কোচ" বলে কটাক্ষ করতেন, তারাও "ভদ্রলোক" হয়ে উঠলেন। বাফুফে এসব মেয়ে বড় হলে তাদের কোনো " কর্মসংস্থান" নয়, "বিয়ের খরচ" দেওয়ার কথা ভাবছে এখনই। ‘বিয়েই ‘’ কি নারীর একমাত্র লক্ষ্য ও আশ্রয় জীবনের ? হায় “ নির্লজ্জ খবিশ পুরুষতন্ত্র! "
মেয়ে ফুটবলারদের বেতন বাড়লো, পুরস্কার জুটলো কপালে। হয়তো এখন প্রগতিশীল ভদ্রলোকেরাও তাদের মেয়েদের ফুটবল খেলায় অংশগ্রহণে আর বাধা দেবেন না পারিবারিকভাবে। দেখা যাক্ !
আর যারা নারীরকে কালো অন্ধকারে বন্দী করে রাখতে সোচ্চার ও সচেষ্ট, তাদের মুখেও চুনকালি দিল হাফ প্যান্ট পরে ফুটবল খেলা বাংলার দামাল মেয়েরা। তার মানে মেয়েরা কথায় নয়, জবাব দিল কাজের ভাষায়। এই কাজই করতে হবে নারীকে। সকল ক্ষেত্রে। পুরুষের একচেটিয়া দখল থেকে নিজেদের অন্তত ন্যায্য ৫০% তাদের ছিনিয়ে নিতে হবে। আর কোনো পথ নেই।
আমি ২০০৯-২০১০ সালে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চাকরিরত ছিলাম। জনাব আবু আলম মোঃ শহিদ খান ছিলেন সচিব। ব্যাচমেট প্রণব কুমার নিয়োগীসহ আমরা কয়েকজন ছিলাম উৎসাহী কর্মী। তখন চালু হয় প্রাইমারী স্কুলে ছেলেদের জন্য বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট এবং মেয়েদের জন্য বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট ---- ইউনিয়ন থেকে রাজধানী। এই কলসিন্দুর মেয়েরা ৩বার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল সেই প্রাইমারী স্কুল লেভেলের বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে। আজ তারা জাতীয় দলের কাণ্ডারী। বয়সভিত্তিক জাতীয় দলে তারাই ১০ জন।
উদ্বোধনী স্মরণিকার জন্য আমি লিখেছিলাম " মেয়েদের পায়ে ফুটবল " শীর্ষক কবিতা। কবিতাটি কিশোরীদের জন্য অন্ত্যমিল দিয়ে সহজ ভঙ্গিতে লেখা কিন্তু অর্থব্যঞ্জনায় যথেষ্ট গভীর ও নিবিড়। আজ সাফ ফুটবলে বাংলাদেশের সোনার মেয়েদের সাফল্যে আমার সেই কবিতারও জয় দেখতে পাচ্ছি। আজকের এই শুভলগ্নে কবিতাটি আবার শেয়ার করে দিচ্ছি। কবিতাটি:--------
ছেলেদের পায়ে ফুটবল ছিল,
ছেলেদেরই হাতে ভলি
আফসোস ভরা চোখ মেলে শুধু
দেখিয়া এসেছে মলি।
হায়, যদি আমি মেয়ে না হয়ে
হতাম মায়ের ছেলে
হয়তো হতাম ইমরান খান--
হয়তো হতাম পেলে।
আমিও হতাম ম্যান অব দি ম্যাচ,
আমিও পেতাম এ্যাওয়ার্ড
ছেলেরাই খেলে ছেলেরাই পায়--
কেন যে এমন রেওয়াজ?
খুশির খবর----- সেদিন গিয়াছে,
ঘুঁচে গেছে ব্যবধান
মলিদের পায়ে ফুটবল ওড়ে--
জলিদের ব্যাটে রান।
জোলেখার পায়ে বল--বা রে বাহ্ ,
অরুণার হেডে গোল!
ম্যাডাম ওড়ায় শাড়ির আঁচল,
স্যারেরা বাজায় ঢোল।
কর্নার কিক--সে কিক দ্যাখো--
লাগে তমসার গায়
যুগে যুগে গড়া অচলায়তন
ভাঙে নাফিসার পায়।
এই পাওগুলো পরবে না আর
অন্ধকারের শিকল
বিজয়ের পথে ফাউল বাধা--
পেনাল্টি শর্টেই বিকল।
“নারী”-- কবিতার ছন্দে ও সুরে
বাজে বিদ্রোহী বাঁশি
বেগম রোকেয়া দেখছেন এ খেলা
আকাশে ছড়িয়ে হাসি।
Comments