২৪-এর ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে আমাদের নজরুল
- মো জেহাদ উদ্দিন
- Jan 25
- 5 min read
‘মহা-বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত/আমি সেই দিন হব শান্ত/যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না/অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না।’
যেখানে বৈষম্য সেখানেই নজরুল, যেখানেই জুলুম, নিপীড়ন, নির্যাতন, সেখানেই নজরুল। “২৪-এর বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের কেন্দ্রবিন্দুতেও ছিলেন আমাদের নজরুল। ২৪-এর ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে আমাদের প্রত্যেকেই একেকজন নজরুল হয়ে উঠেছিলেন। আমাদের দেয়ালে দেয়ালে, মিছিলে মিছিলে ছিলেন নজরুল।
মনে পড়ছে ১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বরের কথা। নজরুলের বয়স তখন ৩০। কলকাতার এলবার্ট হলে নজরুলকে বাঙালির জাতীয় কবি হিসেবে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। সেই অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে বিজ্ঞানাচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বলেছিলেন,
“ফরাসি বিপ্লবের সময় একেকজন ফরাসী অতি মানুষে পরিণত হয়েছিল। আমার বিশ্বাস নজরুল ইসলামের কবিতা পাঠে আমাদের ভাবী বংশধরেরা এক একটি অতি মানুষে পরিণত হবে।”
বিজ্ঞানাচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের কথার বাস্তব প্রতিফলন আমরা দেখেছি ২০২৪ এর ছাত্র-গণঅভ্যু্থানে। নজরুলের চেতনায় উজ্জীবিত একেকজন অতি মানবকে আমরা দেখেছি রাজপথে—যারা আমাদেরকে একটি নতুন বাংলাদেশ উপহার দিয়েছেন। সেই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু বলেছিলেন,
“নজরুল একটা জ্যান্ত মানুষ। নজরুলের স্বপ্ন গোটা বাঙালি জাতির স্বপ্ন। আমরা যখন যুদ্ধে যাব—তখন সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাব, তখনও তাঁর গান গাইব।”
নেতাজী আরও বলেছিলেন, “আমি ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে সর্বদাই ঘুরে বেড়াই। বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষায় জাতীয় সঙ্গীত শুনবার আমার সৌভাগ্য হয়েছে। কিন্তু নজরুলে ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু ’র মত প্রাণমাতানো গান কোথাও আমি শুনেছি বলে মনে হয় না।”
নজরুল যে কতটা জ্যান্ত মানুষ তা এবারেও আমরা টের পেয়েছি। ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রাম, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ, ২৪ এর ফ্যাসিস্ট বিরোধী সংগ্রামসহ আমাদের প্রতিটি আন্দোলনে, সংগ্রামে, অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে অনুপ্রেরণা শক্তি হিসেবে ছিলেন নজরুল।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক পরাধীন দেশের স্বাধীন কবি ছিলেন নজরুল। তথাকথিত বড় বড় রাজনৈতিক নেতারা যখন ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণা করতে দ্বিধান্বিত ছিলেন, ঠিক তখন ‘ভারত হবে ভারতবাসীর এই কথাটিও বলতে ভয়, সেই বুড়োদের নেতা বলিস, ওদের কথায় চলতে হয়’ বলে নিজেই তাঁর অর্ধসাপ্তাহিক ধূমকেতু পত্রিকার ১৯২২ সালের ১৩ অক্টোবর সংখ্যায় ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ৭১ এ মহান মুক্তিযুদ্ধেও্র তাঁর কবিতা ও গান ছিল প্রধান অনুপ্রেরণা। তাঁর জন্মদিনে ১৯৭১ সালের ২৫ মে তারিখে তাঁর দুর্গম গিরি কান্তার মরু গান গেয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র উদ্বোধন করা হয়। মুক্তিযোদ্ধারা তখন দাঁড়িয়ে স্যালুট জানান। ২৪ এর ছাত্র-গণঅভুত্থানেও আমরা তা-ই দেখেছি—কারার ঔ লৌহ কপাট ভেঙে ফেল কর রে লোপাট, এই শিকল পরা ছল মোদের এই শিকল পরা ছল, এর শিকল পরেই শিকল তোদের করব রে বিকল; বল বীর, বল চির উন্নত মম শির ইত্যাদি আমাদের ছাত্র-জনতাকে ফ্যাসিস্ট বিরোধী সংগ্রামে রসদ জুগিয়েছে।
William Radice নামে এক ইংরেজ সাহিত্য সমালোচক Sampling the poetry of Nazrul প্রবন্ধে লিখেন:
‘He was non-communal, and in this he compares well with Tagore who, despite his bid for universality, conspicuously failed to incorporate Muslim tradition into his writing.
Nazrul will be found wherever poetry has been used to fight against oppression…..his appeals were general…
১৯৪১ সালের ৫ ও ৬ এপ্রিল কলকাতা মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির সভাপতির বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগে আমি জন্মগ্রহণ করেছি। এরই অভিযানদলের তুর্যবাদকের একজন আমি—এই হোক আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়।
তিনি লিখেছেন, ‘বন্ধু গো তোল শির, তোমারে দিয়েছি পতাকা মোদের বিংশ শতাব্দীর’। নজরুল প্রদত্ত এই পতাকা ২৪ এর ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে সার্থকভাবে বহন করেছে বাংলাদেশের দামাল ছেলেরা।
ডঃ আশরাফ সিদ্দিকী "যাদের দেখেছি" গ্রন্থে লিখেছেন,
‘বিদ্রোহী কবি নজরুল সম্বন্ধে দেশবাসী অন্য সকলের মতো আমাদেরও আবাল্য উৎসাহ ছিল। সর্বদাই ভাবতাম, একবার কবিকে স্বচক্ষে দেখতে পারলে ধন্য হয়ে যাই। তখন আমি পড়ি ময়মনসিংহ জেলা স্কুলে ১৯৩৮ থেকে ৪২ সনের মধ্যে। ৪১ নম্বর মুকুল মেলা কমিটির তখন আমি সভাপতি। আমার সদস্য নম্বরও ছিল ৪১। এই সময় মোহাম্মদ মোদাব্বের পরিচালিত আজাদের মুকুল মাহফিলে কবি নজরুলের মুকুলের উদ্বোধন নামে একটি অতি চমৎকার কবিতা প্রকাশিত হলো যা পরে নতুন চাঁদ কাব্যগ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। ঐ কবিতার ক’টি লাইন দিয়েই মুকুলের মাহফিলের সদস্য কার্ড ছাপা হতো। আমাদের সদস্য কার্ডে জাতীয় কবির একটি কবিতার কয়েকটি চরণ লেখা থাকত যা আমরা বুকে ঝুলিয়ে রাখতাম:
গোলামীর চেয়ে শহিদি-দর্জা অনেক ঊর্ধ্বে জেনো;
চাপরাশির ওই তকমার চেয়ে তলোয়ার বড়ো মেনো!
আল্লার কাছে কখনও চেয়ো না ক্ষুদ্র জিনিস কিছু,
আল্লাহ্ ছাড়া কারও কাছে কভু শির করিয়ো না নিচু!
জাতীয় কবির রচনায় যে উজ্জীবনী সুধা আছে তা পান করে আমরা দাঁড়াতে শিখেছি, হাঁটতে শিখেছি। তাঁর অনিবার্য প্রভাব থেকে কেউ দূরে থাকতে পারে না। তিনি আমাদের সবাইকে আপন করে জড়িয়ে আছেন।’
মুকুলের উদ্বোধন কবিতার শেষ দু’টি চরণে আমাদের সেই আপন মানুষ নজরুল প্রায় শত বছর আগে শৃঙ্খলমুক্তির যে আহ্বান জানিয়েছিলেন, ঠিক তাতে সাড়া দিয়েই যেন আমাদের ছাত্ররা ২৪-এর অভ্যুত্থান ঘটিয়ে মুক্তির আরাফাত উপহার দিয়েছে: সেই মুকুলেরা এসো মহফিলে, বসাও ফুলের হাট/এই বাংলায় তোমরা আনিয়ো মুক্তির আরফাত।"
নজরুল জাগরণের কবি, মুক্তির কবি, সকল জালিম ও অপশক্তির বিরুদ্ধে অবিসংবাদিত কণ্ঠস্বরের কবি। শিশু, কিশোর, আবাল বৃদ্ধ বণিতা সকলকে তিনি মানবমুক্তির আরাফাতে সমবেত করেছেন। তাঁর শিশুরা বলতে পারে, আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে, তোমার ছেলে উঠলে গো মা রাত পোহাবে তবে।
তাঁর কিশোররা বলতে পারে:
‘মা! আমারে সাজিয়ে দে গো বাইরে যাওয়ার দেশে,
রইব না আর আচল-ঢাকা গণ্ডী-আঁকা দেশে।
মা! এখানে নাই যে জীবন প্রাণের আবীর-খেলা,
আপনাকে যে আপনি মোরা হানছি অবহেলা।
‘স্কুলে যাও, চাকরি কর’-
আদর্শ নাই ইহার বড়,
সকাল বেলা জেগে ওঠা, ঘুমিয়ে সন্ধ্যাবেলা,
দেশ কোথা মা! এ যে শুধু শ্মশান-শবের মেলা।’
তাঁর ছাত্ররা বলতে পারে:
আমরা শক্তি আমরা বল
আমরা ছাত্রদল।
মোদের পায়ের তলায় মুর্ছে তুফান
ঊর্দ্ধে বিমান ঝড়-বাদল
আমরা ছাত্রদল।।
.................................
মোদের চক্ষে জ্বলে জ্ঞানের মশাল
বক্ষে ভরা বাক,
কন্ঠে মোদের কুন্ঠাবিহীন
নিত্যকালের ডাক।
...............................
আমরা রচি ভালবাসার
আশার ভবিষ্যৎ
মোদের স্বর্গ-পথের আভাস দেখায়
আকাশ-ছায়পথ।
মোদের চোখে বিশ্ববাসীর
স্বপ্ন দেখা হোক সফল
আমারা ছাত্রদল।
নজরুলচেতনাসমৃদ্ধ তরুণদের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়:
যখন জালিম ফেরাউন চাহে মুসা ও সত্যে মারিতে ভাই,
নীল দরিয়ার মোরা তরঙ্গ, বন্যা আনিয়া তারে ডুবাই;
আজো নমরূদ ইব্রাহিমেরে মারিতে চাহিছে সর্বদাই,
আনন্দ-দূত মোরা সে আগুনে ফোটাই পুষ্প-মঞ্জরী।।
ভয়-ভীতি দূর করে, জরা-জীর্ণতার বিপরীতে আলোকিত পৃথিবী গড়ে দেয় এই তরুণেরা। তাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় অনবদ্য গান-
ভরসার গান শুনাই আমরা ভয়ের ভূতের এই দেশে,
জরা-জীর্ণেরে যৌবন দিয়া সাজাই নবীন বর-বেশে।
মোদের আশার ঊষার রঙে গো রাতের অশ্রু যায় ভেসে’,
মশাল জ্বালিয়া আলোকিত করি ঝড়ের নিশীথ-শর্বরী।।
তরুণদের আত্মত্যাগের ফলেই রচিত হয় নবযুগ, নবপথ, আসে স্বাধীনতা। হাসিমুখে প্রাণ বিসর্জন দিতে পারা এই তরুণদের চলার পথের চিত্র এবং তাদের মঞ্জিলে মকসুদ নজরুল-কাব্যে উঠে এসেছে এভাবে-
নূতন দিনের নবযাত্রীরা চলিবে বলিয়া এই পথে
বিছাইয়া যায় আমাদের প্রাণ, সুখ, দুখ, সব আজি হ’তে।
ভবিষ্যতের স্বাধীন পতাকা উড়িবে যেদিন জয়-রথে
আমরা হাসিব দূর তারা-লোকে, ওগো তোমাদের সুখ স্মরি।।
২৪-এর অভ্যুত্থানে শাহাদাতবরণকারী তরুণরা নিশ্চয়ই আমাদের সুখ স্মরণ করে দূর তারালোকে হাসছেন। কিন্তু আমরা যদি তাদের স্বপ্ন পূরণে ব্যর্থ হয়, তবে তা হবে চরম আত্মঘাতি এবং তাঁদের ত্যাগের প্রতি নির্লজ্জ বিশ্বাসঘাতকতা।
নজরুল বাংলাদেশের জাতীয় কবি। এতদিন তা মুখে মুখে ছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জাতীয় কবির গেজেট প্রকাশ করতে যাচ্ছে। আশা করি, এ সরকারের হাত ধরে জাতীয় কবির সাংবিধানিক স্বীকৃতিও মিলবে।
নজরুল যে বৈষম্যহীন সমাজ, রাষ্ট্র ও পৃথিবী গড়ার জন্য সর্বশক্তি দিয়ে লড়াই করে গেছেন, নজরুলচেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে বাংলাদেশের ছাত্ররা বৈষম্যবিরোধী সফল অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে নতুন বাংলাদেশ উপহার দিয়েছে, তা মজবুত ও টেকসই করতে হলে এবং তার সুফল সকলের কাছে পৌঁছে দিতে হলে নজরুল চর্চা বেগবান করতে হবে। নজরুলের প্রতি দীর্ঘকালের পরিকল্পিত অবহেলার অবসান ঘটাতে হবে।
(লেখক: অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব। নজরুল গবেষক। ট্রাস্টি, নজরুল ইনস্টিটিউট)
Comentários